করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের চিকিৎসায় গড়ে তোলা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) আইসোলেশন সেন্টারের রিনোভেশন (ভৌত উন্নয়ন কাজ) ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় ‘অনিয়ম’ তদন্ত শুরু করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার টাইগারপাসস্থ চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম। এসময় কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত চসিকের দুই প্রকৌশলীর বক্তব্য সংগ্রহ করেছে দুদক। এছাড়া কেনাকাটা সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্রের ফটোকপিও নিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, গত ৫ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে “২৮০ টাকার বেডশিট কেনা হলো ৭০০ টাকায় ॥ চসিকের আইসোলেশন সেন্টারে বাড়তি দামে পণ্য ক্রয়সহ নানা অসঙ্গতি” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় আইসোলেশন সেন্টারের কেনাকাটার অনিয়ম তদন্তে অনুমোদন দেয়।
এদিকে প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় দুদক সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. আবু সাঈদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম টাইগারপাসস্থ চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে হাজির হয়। প্রথমে তারা চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের কক্ষে হাজির হন। এরপর প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সাথে কথা বলেন। পরবর্তীতে কেনাকাটায় জড়িত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক ও নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সা’দাত মো. আবু তৈয়্যবের সাথে কথা বলেন।
দুদক সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. আবু সাঈদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারের ক্রয় এবং রিনোভেশন সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করছি। সংশ্লিষ্ট দুইজন প্রকৌশলীর বক্তব্য নিয়েছি। ক্রয় সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। আইসোলেশন সেন্টারটির সাথে আরো যারা জড়িত ছিলেন পর্যায়ক্রমে তাদের বক্তব্যও সংগ্রহ করবো।
কোন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইসোলেশন সেন্টারটি নিয়ে পত্রিকায় নিউজ ছাপা হয়েছিল। এরপ্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয় থেকে অভিযান পরিচালনা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করছে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এটা ওদের (দুদক) জিজ্ঞেস করুন। তদন্ত সংক্রান্ত প্রশ্ন আপনারা (সাংবাদিক) করতে পারেন না। সাংবাদিকের এথিকসে তো বলা আছে, কোন বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন। এগুলো তদন্তের বিষয়, এসব সম্পর্কে তো প্রশ্নও করতে পারেন না।
‘যেহেতু আপনাদের প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে, তাই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন বলেই আপনার কাছে জানতে চাওয়া, এমন প্রশ্নে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই।’
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আইসোলেশন সেন্টার নিয়ে তদন্ত চলছে। আমার কাছে সহযোগিতা চেয়েছে, সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো বলেছি। আমরা যে তদন্ত করেছিলাম সে রিপোর্ট চেয়েছে। ওটা দিবো। যে কোন দুর্নীতি অনুসন্ধানকে স্বাগত জানাই।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের চিকিৎসায় আগ্রাবাদ এক্সেস রোডস্থ ‘সিটি কনভেনশন হল’ নামে কমিউনিটি সেন্টারে ২৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটি গড়ে তোলে সিটি কর্পোরেশন। গত ১৩ জুন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এটি উদ্বোধন করেন। ১০ আগস্ট সর্বশেষ সেখানে ৪ জন রোগী ভর্তি হন। কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করার জন্য আইসোলেশন সেন্টারটি ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ১৫৯ জন করোনা রোগী চিকিৎসা নেন সেখানে। এর মধ্যে ১২৯ জন ভর্তি হন এবং ৩০ জন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও গত ২৮ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। সেন্টারটিতে ১৬ জন চিকিৎসকসহ ৯৭ জন কর্মরত ছিলেন, যাদের বিভিন্ন বিভাগ থেকে পদায়ন করা হয়।
আইসোলেশন সেন্টারের যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিতরণ ও স্থাপনে অনিয়ম অনুসন্ধানে প্রশাসকের নির্দেশে গত ১৮ আগস্ট চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়াকে আহবায়ক, হিসাব রক্ষক মাসুদুল ইসলামকে সদস্য সচিব ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরীকে সদস্য করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি অক্টোবর মাসে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে ১৭টি পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিদবেদন সূত্রে জানা গেছে, আইসোলেশন সেন্টারটিতে মোট খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার ৪৪৭ টাকা। এর মধ্যে ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকায় বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এছাড়া ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকায় মাস্ক, ৩ লাখ ৭ হাজার ২৫০ টাকা স্মার্ট সু বাক্স কেনা হয়েছে। রিনোভেশন (ভৌত উন্নয়ন কাজ) খাতে ২৬ লাখ ৬১ হাজার ৯৯৯ টাকা, ওষুধ ক্রয়সহ অন্যান্য খাতে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫০ টাকা, এসি ও আনুসাঙ্গিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাবদ ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫৩ টাকা, নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোজন, সাউন্ড সিস্টেম ও টেলিভিশন ক্রয় খাতে ৭ লাখ ২২ হাজার ৩০০ টাকা এবং খাবার, আবাসন ও স্টেশনারী মালামাল খাতে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৫ টাকা খরচ হয়েছে।
খাতগুলোর বাইরেও নথি অনুমোদন ছাড়াই এবং কার্যাদেশ ব্যতীত কিছু মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে। এ ক্রয় প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এভাবে সরবরাহ নেয়া সমীচীন হয়নি।
প্রতিবেদন সুত্রে জানা গেছে, বাজারে ডিজিটাল থার্মোমিটার বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। অথচ চট্টগ্রাম আইসোলেশন সেন্টারের জন্য কেনা হয়েছে ৭০০ টাকায়। একইভাবে আইসোলেশন সেন্টারটির জন্য ২৮০ টাকার বেড সীট ৭০০ টাকায়, ৩৫০ টাকার রাবার সীট এক হাজার ২০০ টাকায়, ৯৫০ টাকার হ্যান্ড গ্ল্যাবস এক হাজার ৮০০ টাকায় এবং ৪০ টাকার মগ কেনা হয়েছে ১৫০ টাকায়।
বাড়তি দামে এসব পণ্য কেনা হয়েছে ‘মের্সাস এবি কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। দুই লটে প্রতিষ্ঠানটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। যদিও এবি কর্পোরেশন থেকে মালামাল সংগ্রহের পূর্বে ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যের দর সংগ্রহ করেছিল চসিকের ‘কন্ট্রোলার অব স্টোরস’ এর দপ্তর। ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ ডিজিটাল থার্মোমিটার, বেড শীট, হ্যান্ড গ্ল্যাবস এবং মগসহ অন্যান্য পাণ্যের দামের কোটেশন দিয়েছিল এবি কর্পোরেশন এর চেয়ে অর্ধেক দামে।