গত দুই দশকে চিকন চাল তথা সুগন্ধি চালের উৎপাদন দিন দিন কমছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সুগন্ধি চালের কদর বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ছে। চাহিদাও সমানতালে বেড়ে চলেছে। এবারও রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। আগাম চাষ করা কিছু সুগন্ধি চাল এবার রপ্তানিও হয়েছে। এছাড়া অনেক চালের চাহিদাও রয়েছে বাজারে।
কৃষকরা আমন মৌসুমে প্রচলিত জাত কাটারিভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, তুলসীমালাসহ বিভিন্ন সুগন্ধি ধানের চাষ করে আসছেন। প্রচলিত এসব জাতের চাষাবাদে ফলন কম হওয়ায় অনেক কৃষক সুগন্ধি ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম ও দীর্ঘ গবেষণায় সুগন্ধি ধানের স্বাদ ও গন্ধ অক্ষুণ্ন রেখে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ সুগন্ধি ধান উৎপাদনের উপযোগী। দিন দিন সুগন্ধি চালের চাহিদা বাড়ায় গড় উৎপাদন কম হলেও দাম দ্বিগুণ-তিন গুণ পাওয়ায় সুগন্ধি চালের দিকে ঝুঁকছে কৃষকরা। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা সৌরভ দাস জানান, চট্টগ্রামের ৪ জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানে এবার ৭ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানের চাষাবাদ হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছিল ৬ হাজার ১৫১ হেক্টর। এর আগের বছর ছিল তারও কম। গেল অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৪শ ২৭ টন চাল। আশা করা হচ্ছে, এবার উৎপাদন ১২ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে।
আরেকটি সুখবর হলো, প্রধানমন্ত্রীর ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চাল রপ্তানিকারক এফসি ট্রেডিং কর্পোরেশন এই চাল রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে। সেখানে চন্দনাইশ ও মীরসরাই থেকে সংগ্রহ করা চালের অগ্রাধিকার থাকবে বলে জানা গেছে। মীরসরাই উপজেলা কৃষি সুপারভাইজার কাজী নুরুল আলম জানান, মীরসরাইয়ে এবার ২৫০ হেক্টর সুগন্ধি চাল চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষমাত্রা প্রায় ২ টন।
মীরসরাইয়ের আমবাড়িয়া গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম এক সপ্তাহ পরই ধান কাটতে শুরু করবেন। এবার তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে সুগন্ধি ধান করেছেন। এতে প্রায় ৩০০ কেজি চাল পাবেন। কিছু নিজের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেবেন মিঠাছরা হাটে। আশা করছেন, কেজিতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা করে দাম পাবেন। এতে খরচ উঠে অনেক লাভ থাকবে। এভাবে অনেক কৃষক এখন এগিয়ে আসছেন সুগন্ধি নানা জাতের চাল উৎপাদনে। এক দশক আগেও যা কমে গিয়েছিল। দেশ-বিদেশে আমাদের দেশের সুগন্ধি ধানের চাহিদা রয়েছে। গ্রাম বা শহরে ধনী কিংবা গরিব সবার ঘরোয়া উৎসব, গায়ে হলুদ, বিয়ে, ঈদ, পূজায় অতিথি আপ্যায়নে সুগন্ধি চালের পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি, জর্দা, পায়েস, ফিরনি, পিঠাপুলিসহ নানান মুখরোচক খাবার ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে স্থান করে নিয়েছে সুগন্ধি চালের তৈরি খাবার হোটেল, রেস্তোরাঁ। এমনকি পাঁচতারকা হোটেলে কোনো উৎসব বা সেট মেন্যুতেও থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুগন্ধি ধানের ভালো ফলনের জন্য সার ব্যবস্থাপনা জরুরি। রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদ করলে সুগন্ধি চাল বেশি সুঘ্রাণ হয়। এজন্য শতক প্রতি ৪ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে জমির উবর্রতা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ফলন ভালো হয়। খরচ কম হয়, লাভ বেশি হয়। দেশি উন্নতমানের সুগন্ধি চাল সম্পর্কে ধারণা ও প্রচারণার অভাব থাকায় নামী-দামি হোটেল, রেস্তোরাঁয় জনপ্রিয় সুগন্ধি চালের পরিবর্তে বিদেশি চাল ব্যবহার করা যায়। অধিক পরিমাণে সুগন্ধি ধান চাষাবাদে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে সুগন্ধি চালের ব্যাপক চাহিদা।
আরেকটি সুখবর হলো, বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত সুগন্ধি চাল ১৩৬টি দেশে রপ্তানি করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি সুগন্ধি জাতের চালের ওপর নিভর্রতা কমিয়ে বাংলামতিসহ দেশীয় সুগন্ধি চালের আকর্ষণীয় খাবারের প্রতি উৎসাহিত করা গেলে সুগন্ধি ধানের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে আসবে। এতে কৃষকরাও লাভবান হবেন।