তবুও ভালোবাসা

রুনা তাসমিনা | শুক্রবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

উলুধ্বনির সুরে তখনো আচ্ছন্ন করুণা রাণী। কনে বিদায়ের লগ্ন। চোখের দুপাশ দিয়ে অনর্গল ধারায় জল নেমে এসে ভিজছে বালিশ। ঠিক তখনই কলিংবেলটা টুং-টাং করে উঠলো। প্রচণ্ড বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো ভ্রু জোড়া। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো।
-লাবণ্য তুই! এই সাতসকালে! সব ঠিক আছে তো ?
– স-ব ঠিক আছে মা। রাহুল মালয়েশিয়া যাচ্ছে। তাকে এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিয়ে ভাবলাম তোমাদের দেখে যাই। তাই চলে এলাম। কিন্তু তুমি কেন কাঁদছ? কী হয়েছে?
-শরৎ বাবু যে তোর মা’কে কতবার কাঁদিয়েছেন, দেখলে নিশ্চয় তোর মাকে নিয়েই একটি উপন্যাস লিখতেন। কাল থেকে আবার দেবদাস ধরেছে। শেষ হওয়া পর্যন্ত আরো অনেকবার কাঁদবে। তুই ভেতরে আয় মা। হাতের পত্রিকাটি একপাশে রেখে হাসতে হাসতে বললেন অবনী বাবু।
– দেবদাসটা এমন করলে কেন? ওই যে পোড়ামুখী চন্দ্রমুখী? ছেলেটার মাথাই খারাপ করে দিল। একসঙ্গে দু’জনকে কখনো ভালোবাসা যায়? চুনিলাল যদি দেবাকে চন্দ্রমুখীর কাছে না নিয়ে যেতো, পার্বতীর কাছে ঠিকই ফিরে আসতো। বাছা আমার, কতো কষ্ট নিয়ে জমিদার বাড়ির বউ হতে চললো। করুণা রাণীর চোখ আবার ভিজে উঠলো।
-আহা কী সৌভাগ্য পার্বতীর! দু দুটো মা পেয়েছে। আচ্ছা মা,আমার জন্যে কখনো কেঁদেছ অমন করে? হাসতে হাসতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো লাবণ্য। শাড়ির আঁচলে মুছে দিলো মায়ের ভেজা চোখ।
-বালাই ষাট। এমন অলক্ষুণে কথা মুখেও আনবিনা। তোর জন্যে কেন কাঁদবো? সাক্ষাত রাম আমার জামাই। মা লক্ষীর আশীর্বাদ তোদের ঘর জুড়ে থাকুক। হতোভাগি পার্বতী। মেয়েটার জন্যে বড়ো মায়া হয়। আবার গলা ধরে এলো করুণা রাণীর।
– মেয়েটাকে কিছু খেতে টেতে দেবে? নাকি আরো কাঁদবে দেবদাস পার্বতীর জন্যে?
করুণা রাণী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ধীর পায়ে চললো রসুইঘরে। বোঝাই যাচ্ছে দেবদাস থেকে এখনো বেরিয়ে আসেনি তার মন। লাবণ্য পত্রিকাটি টেনে নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
-বাবা, চা খেয়ে একটু হাতিরঝিল যাবে? অনেকদিন যাই না। বাবা, যাবে?
অবণী বাবু মেয়েকে বেশ ভালোই জানেন। কোনো কারণে লাবণ্যের মন আজ খুব অস্থির। ছোটোকাল থেকেই তার এই অভ্যাস। মন খারাপ হলেই বাইরে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতে হতো। ঐটুকুতেই মন ভালো হয়ে যেতো তার। লাবণ্য একেবারে উল্টো মায়ের। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও বোঝার উপায় নেই। অবনী বাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন,
কী এমন হলো। করুণা রাণীকে চায়ের ট্রে হাতে আসতে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন তিনি। চা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো লাবণ্য।
-বাবা, তুমি তৈরি হয়ে এসো।
-কোথায় যাচ্ছিস আবার? ফিরবি কবে?
-একটু কাজ আছে মা। বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওদিক থেকে বাসায় চলে যাবো।
– সে কি! দুপুরে খেয়ে যাবিনা?
– মা,বলেছি তো। আরেকদিন।
ঢাকা শহর এখনো জেগে ওঠেনি পুরোপুরি। হাঁটতে বেরুনো লোকই বেশি রাস্তায়। লাবণ্যদের রিঙা চলছে। কুয়াশা-মাখানো বাতাস ঝাপটা দিচ্ছে মুখে। কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু,ছেড়ে যাইবা যদি-অবনী বাবু ইশারা করলেন মেয়েকে। লাবণ্যও মুগ্ধ রিঙাওয়ালার গানে। কী দরদ তার গলায়! লাবণ্যর ইচ্ছে করছে রিকশা সারাদিন তাকে নিয়ে ঘুরবে। আর এই গানটিই ঘুরে ফিরে শুনবে। রিকশাওয়ালার গানের সুর বাতাসের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। লাবণ্যের মনও হারিয়ে গেলো সেই সুরে।
-কই মা। নেমে আয়। বাবা ডাকছে। রিকশা থেমে আছে হাতিরঝিলের দুই নম্বর ব্রিজের কাছে। ব্রীজের উপর লোকজন বেশি। ওদিকে না গিয়ে ওরা ডানদিকে এগুলো। চুপচাপ হাঁটছে দুজন। অবনী বাবু জানেন সময় হলে লাবণ্য নিজেই বলবে যা বলার। তাই নিজে থেকে বলছেন না কিছু।
-একজন মানুষকে বুঝতে কতোদিন সময় লাগে বাবা? যদি সে খুব কাছের কেউ হয়?
-খুব কঠিন প্রশ্ন মা। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী। যাকে কোনদিনও বোঝা যায়-না। তুই কি এটা বলার জন্যেই বের হয়েছিস?
-না বাবা। বলছি সূর্যটা উঠতে না উঠতেই আবার ডুবে গেলো।
লেকের পানিতে কয়েকটি বোট পানি সরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে লাবণ্য বললো,
– বাবা, কুয়াশায় ঢাকা সকাল কেমন মলিন লাগে। তাই না?। একটা নিঃশ্বাস নিয়ে যেনো নিজেকে প্রস্তুত করলো। অবনী বাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন লাবণ্যের পরের কথাগুলো শোনার। পানিগুলো নীরবে লেকের পাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো শব্দে। ঠিক তেমন নিরব কিন্তু আলতো শব্দে লাবণ্য বললো,
-বাবা, রাহুল আর ফিরবে না। তার জীবনে অন্য কেউ এসেছে। মালয়েশিয়ায় স্যাটেল হবে সে। আজ সকালে যাওয়ার সময় এটাই বলে গেলো।
কী বলছে কী লাবণ্য! অবনী বাবু এই কথা শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। পাঞ্জাবিটা ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। লাবণ্যের চোখে জল নেই। কিন্তু অবনী বাবু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন মেয়ের বুকের পাঁজর ভাঙছে নিঃশব্দে। প্রেম করে বিয়ে করেছে রাহুলকে। মান-অভিমান মাঝেমধ্যে হতো। মেয়ের গলা ভারী হলেই অবনী বাবু সেটা বুঝতেন। করুণাকে কিছু না জানিয়ে নিজেই গিয়ে দু’জনকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু আজ লাবণ্য যা বলছে, তার পরে আর কথা নেই। ভাষা নেই কিছু বলার। অভিমানে গলা ভারী করা মেয়েটি আজ বড়ো বেশি শান্ত। ওরা হাঁটছে ঝিলের পাড় ধরে। সকালের মিষ্টি রোদ হঠাৎ ভীষণ কড়া মনে হয় অবনী বাবুর কাছে। তিনি বসে পড়লেন কাছের একটি বেঞ্চিতে। বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো লাবণ্য। পাশে বসে সস্নেহে হাতটি বাবার পিঠে রেখে বললো,
-সে আমাকে একেবারে বঞ্চিত করেনি বাবা। বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট আমার নামে কিনে রেখে গেছে। দিব্যি আরামে থাকবো আমি সেখানে। বিশাল ঘর জুড়ে শুধু আমি আর আমি। একা আমি। আমার আমি।
-ওই ঘরে থাকার কোনো দরকার নেই। আমার মেয়ে আমার ঘরে থাকবে। কথা বলবো আমি রাহুলের সঙ্গে। ক্ষোভ ঝরে পড়লো অবণী বাবুর কথায়।
– না। দৃঢ় কণ্ঠে বাঁধা দিলো লাবণ্য। যে চলে যায়,তাকে পিছু ডেকোনা বাবা। সে যদি সত্যিই আমার থাকতো, ছেড়ে যেতো না কোনদিন। সে আসলে আমাকে ভালোবাসেই-নি। মা’র ক্ষোভ একদম ঠিক বাবা। পারু,দেবদাসকে কেবল ভালোবেসেই যায়।
-তা-ই যদি হয়, তুই কেন ওর দয়াকে আশ্রয় করে নিবি? ও বাড়িতে তুই থাকবি না। এটাই শেষ কথা আমার।
-এভাবে নিষেধ করোনা বাবা। ওই ঘরের কোথাও না কোথাও রাহুল থাকবে। যাকে ভালোবাসি তার এই দয়া নিতে আমার কেন আপত্তি থাকবে! সে আমাকে একেবারে পথে ফেলে যায়নি।
মনের বাবার সঙ্গে এতোগুলো কথা বলে ফেললো লাবণ্য। পাশে হাঁটতে থাকা প্রবীণ লোকটি তার কিছুই জানলোনা। লাবণ্য জানে, বাবা অপেক্ষা করছে তার কথা শোনার। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ। সব পরিবেশে সব কথা কেন জানি বলা যায়-না। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো লাবণ্য। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো শুধু,
-রাহুল হঠাৎ চলে যাওয়ায় মন খারাপ লাগছিলো। তাই ঘুরতে এলাম কিছুক্ষণ। চলো বাবা। বাসায় ফিরতে হবে।
বলেই লাবণ্য হাঁটা ধরলো ফিরতি পথে। অবনী বাবু কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ফিরে চললেন মেয়ের সঙ্গে।
বাসায় ফেরার পথে অটোরিকশায় বসে লাবণ্য বিভিন্নভাবে কথাগুলো সাজালো। কিন্তু এমন একটিও উপায় খুঁজে পেলোনা, যা বললে মা-বাবার মনের কষ্ট কিছুটা কম হতে পারে। লাবণ্যের বিভিন্ন আবদারে মা কখনো বাধ সাধলেও বাবা মেয়ের পক্ষই নিতেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে অনেক সময় কথা পর্যন্ত বন্ধ থাকতো। লাবণ্য উদ্বিগ্ন হলে বাবা ইশারায় বুঝিয়ে দিতেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজ? রাহুলের ব্যাপারটা বাবা নিজেই কতটুকু সহ্য করতে পারবে তার ঠিক নেই। মাকে কী বোঝাবে! মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির তিন নম্বর রোডে এসে অটো চালক জানতে চাইলো কোথায় নামবে। শারমিন স্টোর ফেলে একটু সামনে গিয়ে থামতে বললো লাবণ্য। বাসার গেটের ভেতরে যেতেই সিকিউরিটি গার্ড একটি পার্শেল এগিয়ে দিলো। বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে এসেছে। ঠিকানায় নিজের নাম দেখে গা টা কেমন কেঁপে উঠলো। গার্ডের হাত থেকে পার্শেলটি নিয়ে দ্রুত উঠে এলো সিঁড়ি বেয়ে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। চারতলায় ফ্ল্যাটের সামনে এসে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। রাহুল! রাহুল দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে! লাবণ্যকে এমন হন্তদন্ত হয়ে উপরে আসতে দেখে বললো,
-অতো তাড়াহুড়োর কী আছে? যাবো তো একসঙ্গে।
-ক-কোথায়? কাঁপা গলায় লাবণ্যের প্রশ্ন।
-পার্শেলটা খুলে দেখো।
মাথা ঝিমঝিম করছে লাবণ্যের। কাঁপা হাতে খুলতে লাগলো হাতের পার্শেলটি। আশা- নিরাশার তীব্র দোলায় দুলছে মন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাজীর দেউড়ির ‘মীরা পুকুর’ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধদৌড়ায় চোখ