নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দায়ের হওয়া বেশিরভাগ মামলা আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। মামলা দায়েরের পরবর্তীতে একটি সময় আসামিপক্ষের সাথে আপোষনামায় গিয়ে ভিকটিম মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করছে। সম্প্রতি এ আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো আপোষে নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। গত অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের সাতটি ট্রাইব্যুনাল মিলে ১১৩টি বিচারাধীন মামলা অন্যভাবে নিষ্পত্তি দেখানো হয়েছে। একই মাসে ট্রাইব্যুনালগুলোর ৮৫ টি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় মামলাগুলো খালাস করে দেয়া হয়েছে। ৩২ টি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি (ডিসচার্জ) পেয়েছেন। অন্যদিকে ১৭ মামলায় আসামিরা সাজা পেয়েছেন।
আদালত ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের তথ্যে, ট্রাইব্যুনালগুলোর অক্টোবর মাসের প্রতিবেদনে অন্যভাবে নিষ্পত্তি দেখানো ১১৩ টি মামলা বাদী ও আসামিপক্ষ আপোষনামায় গিয়ে মামলা তুলে নেয়ার আবেদন করেছেন। আদালত আবেদনের প্রেক্ষিতে আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করেছেন।
জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭’র বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট খন্দকার আরিফুল আলম গতকাল আজাদীকে বলেন, সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সর্বশেষ সংশোধনীতে ১১ (গ) ধারা মামলা ‘আপোষযোগ্য’ করা হয়েছে। একই ধারায় আগে এটা ‘অ-আপোষযোগ্য’ ছিল। এ আইনের ধারা সংশোধনের ফলে বর্তমানে বেশিরভাগ মামলা আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। আদালতে উভয়পক্ষ আপোষনামায় গিয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করছে। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাৎক্ষণিক মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করছেন। আগে বাদীপক্ষের এই ধরণের সুযোগ ছিল না বলে জানান ট্রাইব্যুনালের এ আইন কর্মকর্তা।
আইনজীবীরা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন, স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হচ্ছে। এসব অপরাধের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো মূলত বেশিরভাগই আপোষে নিষ্পত্তি হচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩’র পিপি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম সেন্টু আজাদীকে বলেন, যৌতুক, নির্যাতনসহ নানা কারণে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর করা মামলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে আপোষ হচ্ছে। বিভিন্ন শর্তে উভয়পক্ষ আপোষনামায় যাচ্ছে। এতে এ ধরণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী নারীর করা মামলাও আপোষনামার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। ভিকটিমকে বিয়ে করার শর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে আপোষনামার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, আপোষনামার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা।
অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম সেন্টু বলেন, একটি ধর্র্ষণের মামলার বিচারকাজ যখন আট/দশ বছর ধরে চলতে থাকে, তখন সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আদালতে নির্ধারিত ধার্য্য তারিখে সাক্ষীকে উপস্থিত করা যায় না। এতে আসামিপক্ষসহ বিভিন্ন চাপের কারণে বাদী পরবর্তীতে মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার কোনো মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একটি মামলা দীর্ঘসময় বিচারকার্য চলাকালীন অবস্থায় দেখা যায় ভিকটিমের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। তখন বাদীর পরিবার মেয়ের সংসারের কথা চিন্তা করে মামলা মোকাদ্দমা চালাতে অনাগ্রহ দেখায়। পরবর্তীতে বাদীপক্ষ সবকিছু বিবেচনায় এনে মামলা তুলে নিচ্ছে। এছাড়া হুমকি-ধমকি বা আর্থিক লোভে পড়ে ভুক্তভোগীরা আসামিদের সাথে পরবর্তীতে আপোষ করে ফেলছে।
ট্রাইব্যুনালের তথ্যে জানা গেছে, গত অক্টোবরে ৮৫ টি মামলা খারিজ করা হয়েছে। বাদীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব মামলা খারিজ হয়েছে।
তথ্যের বরাতে জানা গেছে, চট্টগ্রামে ৭ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মোট ১৪ হাজার ২৩৩ টি মামলা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ এ রয়েছে ৩ হাজার ৪০৬ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-২ এ ২ হাজার ৪৭০ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৩ এ ২ হাজার ১২১ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৪ এ ২ হাজার ৩৯৫ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৫ এ ১ হাজার ৬২৬ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৬ এ ১ হাজার ১৬১ টি মামলা ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এ ১ হাজার ৫৪ টি মামলা। আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা নথি নির্ভরের পাশাপাশি সাক্ষী ও আলামত নির্ভর। এসবের ঘাটতি থাকলে মামলা প্রমাণ করা যায় না।