জনগণের চলাচলের পথ জনগণেরই থাকবে। আমাদের শহর, আমাদেরই করা হবে। নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা নিয়ে কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেয়া হবে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের এ প্রত্যয়কে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে হকাররা। গত ২৩ ও ২৪ নভেম্বর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, বাদুরতলা এলাকার একাধিক জনের সাথে আলাপকালে তাদের একটাই প্রশ্ন তবে কি হকাররা নগর প্রশাসকের চেয়েও ক্ষমতাশালী ? এমন বেপরোয়া মনোভাব তারা কীভাবে দেখাতে পারে? কার শক্তিতে বলীয়ান তারা? শুধু ফুটপাত নিয়ে নয়, একইসাথে সড়ক দখল করেও চলছে চাঁদাবাজি। ফুটপাতে হকার বসিয়ে, সড়কে অবৈধ গাড়ি স্ট্যান্ড কিংবা ভ্যান গাড়ির ভাসমান বাজার বসিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপ নামে-বেনামে বহদ্দারহাট, মুরাদপুরের সড়ক-ফুটপাত দখলে যেন প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মীর ইন্ধনে এসব ফুটপাত-রাস্তা দখলের অপতৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীরও দুর্ভোগ বাড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্র দীর্ঘদিন ধরে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সন্ত্রাসীদের নামধামসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় আবেদন করা হলেও তেমন কোনো সুফল মিলেনি। সন্ত্রাসীরা বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অন্তত গত দশ বছর ধরে দোর্দন্ড প্রতাপে চক্রটি এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি রাস্তা ও ফুটপাত পৃথক পৃথক ব্লকে বিভক্ত করে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে চলছে চাঁদাবাজি।সরেজমিন বহদ্দারহাট, মুরাদপুর ও বাদুরতলা ঘুরে দেখা যায় মূল সড়কের সামনের ফুটপাত এবং সড়ক দখল করে রেখেছেন দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কোথাও কোথাও ফুটপাতে হকার বসিয়ে, সড়কে অবৈধ গাড়ি স্ট্যান্ড কিংবা ভ্যান গাড়ির ভাসমান বাজার বসিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয় টাকা। চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের সামনে ওয়াসার বড় পাইপ বসানোর কাজ চলতে থাকায় আপাতত ঐ স্থানে হকার কম। তবে ওখানকার হকারদের অন্য স্থানে বসার ব্যবস্থা ঠিকই করে দিয়েছে স্থানীয় বখরা আদায়কারীরা। বিভিন্ন ধরনের ফলের দোকান বসিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। একটি দোকান থেকে দৈনিক চারশ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয় বলে সরেজমিন অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু ফুটপাতই নয়; সড়ক জুড়ে ভ্যান গাড়িতে বসে ভাসমান বাজার। বহদ্দারহাট পুলিশ বঙের সামনের সড়কের এক পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে টেম্পো স্ট্যান্ড। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের মোড়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে রাস্তা থেকে দুটি টেম্পো স্ট্যান্ড চলছে। মদিনা হোটেল ও ওয়াপদার সামনে সড়কের উপর পৃথক ভাবে আছে দুটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। চান্দগাঁও থানার পাশেই বহদ্দার বাড়ি মসজিদের সামনে থেকে বলিরহাট পর্যন্ত চলাচলকারী অবৈধ টেঙি স্ট্যান্ড এলাকাবাসীর নিত্য দিনের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুরাদপুর ফ্লাইওভারের আগে রাস্তার দুই পাশে স্থানীয় ব্যবসায়িরাই ফুটপাত দখল করে নিয়েছেন।
সন্ত্রাসীদের দখলদারিত্বের কারণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা সমপ্রসারণের উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। ফুটপাত সংস্কারেও কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সাথে লুকোচুরি খেলছে যেন অবৈধ দখলদাররা। তিনি সম্প্রতি বহদ্দারহাট পরিদর্শনে গেলে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত হয়ে যায়। তিনি ফিরে আসার পরপরই জমজমাটভাবে শুরু হয় দখলদারিত্ব।
বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, শুধু বহদ্দারহাট চত্বর নয়, পুরো চান্দগাঁও এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে যত্রতত্র গাড়ি স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। সড়ক জুড়ে ভ্যান গাড়িতেও বসে ভাসমান বাজার। আর এসব স্ট্যান্ড থেকে রুট পারমিট বিহীন শত শত গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগর ও জেলায়।
খাজা রোড এলাকার মো. জাফর নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ফুটপাত দখল করে এ এলাকায় হকারদের ব্যবসা দীর্ঘ দিনের। গেলো বছর সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানে দখল কিছুটা কমলেও এখন তা দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে ফুটপাত পুরোটা দখল হয়ে যাচ্ছে। পথচারীরা বাধ্য হয়েই সড়কে চলাচল করছেন। তাদের অভিযোগ, বহদ্দারহাট এলাকায় হকারদের ফুটপাত দখলের নেপথ্যে রয়েছেন পুলিশ ও দাগী কয়েকজন ব্যক্তি।
অভিযোগে জানা যায়, বহদ্দারহট এলাকায় কাঁচাবাজার থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যন্ত টাকা তোলা হয় কিশোর গ্যাং লিডার এসরাল ও মহিউদ্দিন ফরহাদের নামে। টাকা তোলার দায়িত্বে আছে সাইফুল মজুমদার মন্টু, চাকমা সুমন, ফ্্রুট সোহেল, জসিম ও রুবেল। পুরাতন চান্দগাঁও, বিসিক শিল্প এলাকা ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত সক্রিয় গ্রুপটি। এছাড়া কিশোর গ্যাং লিডার নোমান চৌধুরীর একটি গ্রুপ ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে সক্রিয়। বহদ্দার হাট পুলিশ বঙের সামনে থেকে পূর্ব ষোলশহর হয়ে খাজা রোড পর্যন্ত টাকা আদায় করে ধামা জুয়েল, মুরাদ, ল্যাংড়া রিফাত, অভি, হামিদ ও রাকিব। এই গ্রুপের লিডার পেশাদার সন্ত্রাস হামকা রাজু সম্প্রতি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে।
প্রশাসক সুজন বলেন, এবার ঝটিকা অভিযান চালিয়ে রাস্তা কিংবা ফুটপাতে যা পাবো সব কর্ণফুলিতে ফেলবো। তিনি বলেন, হকারদের বিকেল তিনটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সময় দিয়েছি। একটি হ্যাঙার থাকবে, একটি বাঙ থাকবে। হ্যাঙারে কিছু পণ্য ঝুলবে, বাঙে বাকি মালামাল থাকবে। রাত আটটায় যাওয়ার সময় হ্যাঙার এবং বাঙ দু’টিই নিয়ে যাবে। রাস্তা এবং ফুটপাতে অন্য কিছু রাখতে দেয়া হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি নগরবাসীর সহায়তা চেয়ে নগরীকে নগরীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।