আন্দরকিল্লায় রাজার পুকুরে যাওয়ার রাস্তাকে কেন্দ্র করে নামকরণ করা হয়েছে রাজা পুকুর লেইন। রাস্তাটি আছে। কিন্তু পুকুরটির অস্থিত্ব নেই। ওই এলাকায় যে মাত্র বছর কয়েক আগেও বড়সড় একটি পুকুর ছিল তার কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। একইভাবে দেওয়ান বাজারের দেওয়ানজি পুকুরে যাওয়ার রাস্তাটির নামই দেওয়ানজি পুকুর লেইন। এখানেও রাস্তাটি আছে। কিন্তু পুকুরটির অস্থিত্ব নেই। ওই এলাকায়ও যে একটি পুকুর ছিল তার কোনো চিহ্ন নেই। এভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর রাজার পুকুর কিংবা রানীর পুকুরের পাশাপাশি গায়েব হয়ে গেছে কাজীর পুকুর। মুন্সির পুকুর। মিয়াদের পুকুরসহ বহু পুকুর। গত দুই যুগে নগরীতে বিলীন করে দেয়া হয়েছে অন্তত বিশ হাজার পুকুর। ভূমির মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নগরীতে একের পর এক পুকুর ও দীঘি ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে নগরীর আশকারদীঘি, বলুয়ারদীঘি ও ঢেবাসহ বড়বড় যেসব জলাধারগুলোও টিকে আছে তাও বর্তমানে চতুর্মুখী ভরাটের কবলে রয়েছে। বিভিন্্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পুকুর দীঘি ও জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের বহুমুখী সংকট তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশের সুরক্ষায় পিএস এবং বিএস জরিপে চিহ্নিত পুকুরগুলো উদ্ধার করারও দাবি উঠছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে এক সময় প্রচুর দীঘি পুকুর ও জলাশয় ছিল। বিখ্যাত বিখ্যাত সব দীঘি ও জলাশয় নগরবাসীর পানীয় জলের চাহিদা মেটাতো। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণেও ছিল বহু জলাশয়। রেলের প্রয়োজনীয় পানির যোগান এসব দীঘি ও জলাশয় থেকে দেয়া হতো। ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজনীয় পানির যোগানও মিলত নগরীর বিভিন্ন পুকুর ও জলাশয় থেকে। নগরজুড়ে বিস্তৃত পুকুর ও জলাশয় নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের ক্ষেত্রেও অনন্য ভূমিকা রাখতো।
১৯৮০ সালের বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর, দীঘি ও জলাশয় থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। আশির দশকের শুরু থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পুকুর জলাশয় ভরাটের হিড়িক শুরু হয়। যে যেদিকে পারে পুকুর দীঘি ভরাট করে আবাসন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর উল্লেখ করে, ওই সময় চট্টগ্রামে সর্বমোট পুকুর দীঘি এবং জলাশয় ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। নব্বইর দশকে চট্টগ্রামে জলাশয় ও পুকুরসহ জলাধার ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। ২০০৬ সালে এসে সিডিএ এক জরিপে উল্লেখ করে, নগরীতে পুকুর দীঘির সংখ্যা ৪ হাজার ৫২৩টি জলাধার। পুকুর দীঘি ভরাটের মহোৎসব চলাকালে নগরীর বহু বিখ্যাত পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে। এই সময় ভরাট করে ফেলা হয়েছে আন্দরকিল্লার রাজাপুকুর। নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে দেওয়ান বাজারের দেওয়ানজি পুকুর কিংবা নন্দনকাননের রথের পুকুরের মতো বিখ্যাত সব পুকুর। ফিরিঙ্গিবাজারের দাম্মো পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দীঘি, কাট্টলীর পদ্মপুকুর, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দীঘি, মিনামার দীঘি, মোহাম্মদ খান দীঘি, কারবালা পুকুর, মৌলভী পুকুরসহ অসংখ্য পুকুর ও দীঘির চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। অন্তত ২০ হাজার ছোট বড় পুকুর দীঘি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃতি, মানুষের সচেতনতা, আইনের কড়াকড়ি এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থা সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেভাবে অতীতে পরিলক্ষিত হয়নি মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ হলে এভাবে পুকুর দীঘি নিশ্চিহ্ন হতো না। জলাশয় সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর উদ্বৃতি দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, আইন অনুযায়ী পুকুর-দীঘি ভরাট নিষিদ্ধ। ভূমির রেকর্ডে আরএস (রয়েল সার্ভে) ও বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে)-এ জলাশয় থাকলে তা কোনো ভাবেই ভরাট করা যাবে না। সিডিএর ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ডিএপি) পুকুর চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পুকুর ভরাট না করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনায় কমপক্ষে ১৫ কাঠা আয়তনের বড় জলাশয় কোনো ভাবেই ভরাট করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুকুর এবং দীঘি ভরাটের ফলে ফায়ার সার্ভিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। অগ্নি নির্বাপণের সময় পানির সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যে কোনো পুকুর ভরাটের আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে এনওসি (অনাপত্তিপত্র) নেয়ার নিয়ম থাকলেও চট্টগ্রামে এই ধরনের কোনো অনাপত্তি কেউ নেননি।
সরেজমিন পরিদর্শন দেখা গেছে, বর্তমানে নগরীর রানীর দীঘি, আসকার দীঘি, বলুয়ার দীঘি, আগ্রাবাদের দাম্মো দীঘি, ডেবা, হামজা খাঁর দীঘি, বড় পুকুর, অঙিজেনের জোহুরা পুকুর, পাহাড়তলী এবং আকবর শাহ থানা এলাকায় অনেকগুলো পুকুর এবং জলাশয় চতুর্মুখী ভরাটের শিকার হচ্ছে। নানা কৌশলে চলছে পুকুর দীঘি ভরাটের কার্যক্রম। নগরীর প্রতিটি এলাকায় কমবেশি পুকুর ও জলাশয় ভরাটের কার্যক্রম চলছে। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় করে ভরাট করা হচ্ছে। এসব ভরাট কার্যক্রমের সাথে প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
পুকুর ও দীঘি ভরাটের ব্যাপারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা কোনো ধরনের জলাশয় ভরাটের সুযোগ কাউকে দিচ্ছি না, দিইনি। পুকুর ভরাট করা ভূমিতে আমরা কোনো প্ল্যান দিই না। তবে বিএস জরিপে যদি পুকুর দীঘি বা জলাশয় উল্লেখ না থাকলে সেক্ষেত্রে আমরা কারো প্ল্যান আটকাতে পারি না। আমাদের ডিএপিতে পুকুরের জায়গা চিহ্নিত রয়েছে। এসব স্থানে আমরা কোনো ধরনের প্ল্যান দেবো না। তিনি বলেন, পুকুর জলাশয়ের সুরক্ষা খুবই জরুরি একটি বিষয়। আমরা বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরীর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, মানুষ লোভী হয়ে গেছে। ভূমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ জলাধার ভরাট করে ঘর করছে। দোকান করছে। ইন্ডাস্ট্রি করছে। মানুষ মনে করছে লাভ করছে। কিন্তু ব্যক্তি লাভ সমাজের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। পরিবেশ ধ্বংস করছে। তিনি আরো বলেন, আগুন লাগলে এক বালতি পানির জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বড় ধরনের সর্বনাশ ঘটাবে। তিনি, পুকুর এবং জলাধার ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা এবং জরিমানা করা হয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি আদালতেও বেশ কিছু মামলা রুজু করা হয়েছে বলে দৈনিক আজাদীকে জানান। পাশাপাশি তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিজেদের সামর্থ্যনুযায়ী জলাশয় ভরাটের অপকর্ম ঠেকানোর চেষ্টা করেন বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা বিএস জরিপের সমালোচনা করে বলেন, বহু ক্ষেত্রে জলাশয়কে জরিপে ‘নাল’ জমি দেখানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পুকুর ভরাট করা হলেও আইনে বাঁধা দেয়া কঠিন হয়ে উঠছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাশয় ভরাট করাসহ পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজের বিরুদ্ধে জনসচেতনার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, এই ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরই নয়, যে কোনো ব্যক্তিই আদালতে মামলা করতে পারেন। জনসচেতনাই পুকুর এবং জলাশয় ভরাটকারীদের দৌরাত্ম ঠেকাতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।