ফুটপাত সড়ক হকারদের দখলে

নেপথ্যে সিন্ডিকেট, মোটা অংকের অবৈধ আয় প্রায় সময় ঘটে সংঘর্ষ, দুর্ভোগে মানুষ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

নগরীর আগ্রাবাদকে বলা হয় বাণিজ্যিক এলাকা। সেই বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাত ঘিরে শত শত ভাসমান ব্যবসায়ী ও হকার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিএমপির ট্রাফিক অফিসের (বন্দর ও পশ্চিম) সামনেই হকারদের জমজমাট ব্যবসা চললেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন নীরব। ট্রাফিক অফিসই শুধু নয়, এসব ভাসমান হকার পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে। গড়ে তুলেছে অস্থায়ী নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিপুল মানুষের আনাগোনার কারণে এখানকার বিশাল ফুটপাত ঘিরে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এসব দোকান হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসীদের অবৈধ আয়ের বড় উৎস। নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, সরকারদলীয় নেতাকর্মী। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়শ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর মারুফ চৌধুরী মিন্টু (৩২) নামে এক যুবলীগ কর্মী খুন হন প্রতিপক্ষের হাতে। অভিযোগ আছে, কোথাও কোথাও পুলিশও অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয়। এ কারণে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত হচ্ছে না। এদের উচ্ছেদ করা হলেও আবার বসে যায়। সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, চট্টগ্রামে হকার বসবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ৬ সেপ্টেম্বর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। আয়-রুজির পথ নিশ্চিত করতে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তালিকাভুক্ত হকারদের ব্যাচ ও ইউনিফর্ম পরতে হবে বলে জানানো হয়েছে। নিয়ম অমান্যকারীদের কোনো ছাড় নেই বলে জানান তিনি। কিন্তু আগ্রাবাদে গিয়ে দেখা গেছে, ইউনিফর্ম, ব্যাচ কিছুই নেই। এমনকি চসিক প্রশাসকের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময়সীমাও মানছে না তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কমার্স কলেজ, ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার, আগ্রাবাদ হোটেল, হোটেল সেন্টমার্টিন, টিঅ্যান্ডটি, বিদ্যুৎ অফিস, আখতারুজ্জামান সেন্টার, উইমেন চেম্বার, অপর দিকে সড়কের পশ্চিম পাশে সোনালী ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সিঙ্গাপুর মার্কেটের সামনের সড়কের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালানো হচ্ছে। সেই ফুটপাতে পাওয়া যায় জুতাসহ নানা পণ্য। আবার জনতা ব্যাংকের পাশের সড়ক, যা সোজা কমার্স কলেজে গেছে, সেটা দখল করে জুতাসহ নানা পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছে ভাসমান হকাররা। তারা সড়ক দখল করে বড় সাইজের ছাতা টাঙিয়ে নানা পণ্য বিক্রি করছে। শুধু এসব এলাকা নয়, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে আগ্রাবাদ চৌমুহনী পর্যন্ত প্রধান সড়কের ফুটপাতও দখল করা হয়েছে।
আগ্রাবাদ বাদামতলী থেকে শুরু করে শেখ মুজিব রোড ও আগ্রাবাদ এঙেস রোডের ফুটপাত ও সড়কের একাংশ হকারের দখলে থাকে। এখন হকারদের পসরা আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার প্রায় প্রতিটি সড়কে বিস্তৃত হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরে দেখা যায়, চার লেনের রাস্তার দুই পাশে ৬০ শতাংশ জায়গা হকাররা দখল করে রেখেছে। রাস্তার উপরে করা হচ্ছে কার সার্ভিসিং, মোটরসাইকেল সার্ভিসিং ও টং দোকান। এসব এলাকার ফুটপাত দূরের কথা, রাস্তা দিয়ে হাঁটাও কষ্টকর। দখলের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় গাড়ি চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যস্ততম সড়কটিতে দিনের বেশিরভাগ সময় যানজট লেগে থাকে।
মো. জানে আলম নামে এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে পুরনো বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ। সেখানে রয়েছে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি অফিস। বড় মার্কেটও রয়েছে। চৌমুহনীতে আছে কর্ণফুলী বাজার। সেই বাণিজ্যিক এলাকার সুনাম নষ্ট করে ফুটপাতকে এক শ্রেণীর টাউট-মাস্তানরা দখল করে ভাড়ায় লাগিয়েছে। নতুন প্রশাসক আসার পর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করলেও গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের অবৈধ দখল উচ্ছেদে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। এতে হতাশ ভুক্তভোগীরা।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে আগ্রাবাদ এলাকার ভুক্তভোগী এক ব্যবসায়ী বলেন, আগ্রাবাদ এলাকার বিভিন্ন সড়কে টাকার বিনিময়ে ছোট ছোট ভ্যানগাড়ি ও দোকান বসিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া তুলে সরকারি সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এছাড়া পিডিবির লাইন থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাস্তার উপর বসানো দোকানিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১৫০ টাকা করে আদায় করছে। কোনো হকার যদি দৈনিক ও মাসভিত্তিক নির্ধারিত চাঁদা না দেয়, তাহলে সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের মারধর ও নির্যাতন করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরো আগ্রাবাদ এলাকার এক প্রকার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন যুবলীগ নেতা খুরশীদ আহম্মদ। তিনি গড়েছিলেন একটি বাহিনীও। সে বাহিনীর মাধ্যমে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, মাদকের কারবার ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাকে ধরতে গিয়ে পুলিশও হামলার শিকার হয়েছিল। মোটা অংকের টাকা নিয়ে ফুটপাতে হকার বসাতেন তিনি। প্রতিদিন তার সাঙ্গপাঙ্গ হকারদের কাছ থেকে টাকা তুলত। তার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন আগ্রাবাদ ও আশেপাশের এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। আগ্রাবাদে নিজের আখড়ায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন খুরশীদ। এ খবর জানাজানির পর স্বস্তি নেমে আসে আগ্রাবাদ এলাকায়।
স্থানীয়রা জানান, আগ্রাবাদে মারুফ চৌধুরী মিন্টু হত্যার নেপথ্যে রয়েছে ওয়ার্ড ও নগর যুবলীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব। মারুফের বড় ভাই আলমগীর চৌধুরী আলোর সঙ্গে অপর যুবলীগ নেতা মোস্তফা কামাল টিপুর বিরোধ রয়েছে। ফুটপাত নিয়ন্ত্রণসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এলাকাভিত্তিক বিরোধের জেরে খুন হন যুবলীগ নেতা আলমগীর চৌধুরী আলোর ছোট ভাই মিন্টু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুরশীদের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাত ও সড়কের একাংশে প্রতিটি ভ্যান ও ভাসমান দোকান থেকে এককালীন নেওয়া হয় ২০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে প্রতিটি ভ্যান থেকে ভাড়া নেওয়া হয় দেড় হাজার; দোকানগুলো থেকে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। এছাড়া পুলিশের নামেও করা হয় চাঁদাবাজি। পুলিশকে ম্যানেজ করার নামে প্রতি মাসে প্রত্যেক হকার থেকে তোলা হয় সাড়ে ৭শ টাকা। বর্তমানে হকারদের থেকে চাঁদা আদায় হয় আবদুল কাদের, মোস্তফা কামাল টিপু ও এইচ এম পারভেজের নামে। এদের হয়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত পনের মামলার আসামি সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন, আলমগীর ওরফে পিচ্চি আলো ও শেখ তৌহিদুল ইসলাম। এছাড়া ব্যাংকক সিঙ্গাপুর মার্কেট থেকে ছোটপোল, বড়পোল ঘিরে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত আজিজুর রহমান আজিজ গ্রুপ ও সালেহ আহমেদ দিঘলের গ্রুপ।
সিএমপির ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ আজাদীকে বলেন, হকারদের বসার অনুমতি দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। এখানে পুলিশের কী করার আছে? তবে হকারদের এ ব্যবসাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে আমরা ব্যবস্থা নিই।
তিনি বলেন, ১২ নভেম্বর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারুফ চৌধুরী মিন্টু নামে একটি ছেলে মারা গেছে। এ ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি এবং প্রধান আসামি রমজানকে ভারতে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করে এনেছি। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চাঁদাবাজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মৌখিক অভিযোগের তো কোনো ভিত্তি নেই। লিখিত অভিযোগ কেউ দিতে চায় না। অভিযোগ দিলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসচেতনতায় জোর সরকারের
পরবর্তী নিবন্ধচন্দ্রঘোনায় বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষ, আহত ১০