ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করলো ‘বিদ্যানন্দ মা ও শিশু হাসপাতাল’। নগরীর পাহাড়তলী সাগরিকা রোডে আট তলা একটি ভবনে হাসাপাতালটি চালু করেছে স্বেচ্ছাসেবকমূলক সংগঠন ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’। দরিদ্র জনগোষ্ঠী মাত্র এক টাকায় চিকিৎসা সেবা পাবেন এ হাসপাতালে। তাছাড়া টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম মূল্যের যে কোনো জিনিসের বিনিময়েও এখানে সেবা নিতে পারবেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। গতকাল হাসপাতালটির আউটডোর সেবা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। হাসপাতালটির আউটডোরে প্রতি মাসে ১০ হাজার দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিদ্যানন্দ কাজ করছে বলে জানানো হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’- সেবার এই ব্রত নিয়ে কাজ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এক টাকার আহারের পর এবার সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এক টাকায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সংগঠনটি। আর এ লক্ষ্যেই চালু করা হয়েছে বিদ্যানন্দ মা ও শিশু হাসপাতাল। গতকাল হাসপাতালটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিশেষ অতিথি ছিলেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার একেএম তফাজ্জল হক। সভাপতিত্ব করেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পরামর্শক ও নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম।
করোনাকালীন জরুরি চিকিৎসা সেবায় ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সিএমপি-বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসপাতাল’ ও ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন খেয়া’-র অভিজ্ঞতা নিয়ে এই হাসপাতালটি চালু শুরু করলো বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। হাসপাতালটি গড়ে তুলতে আবাসিক সহযোগিতা দিয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটি সিএমপি-বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসপাতালের জন্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রাথমিকভাবে হাসপাতালটিতে আউটডোর সার্ভিস চালু করা হয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের সমন্বয়ক জামাল উদ্দিন জানান- চলমান করোনা মহামারীতে আক্রান্তদের সহায়তা দিতে ১৬ শয্যার একটি পৃথক কোভিড ওয়ার্ডও থাকছে হাসপাতালে। কোভিড ওয়ার্ড ছাড়াও প্রস্তাবিত ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে ২১ শয্যার জেনারেল ওয়ার্ড, ১২ শয্যার ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড ও এক শয্যার ডেন্টাল ইউনিটে সেবা দেয়া হবে। এছাড়াও দেশের প্রান্তিক জনপদে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকছে টেলিমেডিসিন সার্ভিস। দেশ বিদেশের অভিজ্ঞ কনসালট্যান্ট যুক্ত থাকবেন ছিন্নমূল মানুষের সেবায়। প্রাথমিকভাবে আউটডোর সেবা চালু হলেও পরবর্তীতে ইনডোর সেবা চালু করা হবে। আর ইনডোর সেবা চালু হলে এক টাকা খরচেই সুবিধা বঞ্চিত মানুষ থাকা-খাওয়াসহ সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পাবে।
সংগঠনের সদস্যরা জানান- মাত্র এক টাকায় দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা ও ওষুধ পাবেন এ হাসপাতালে। এছাড়া টাকার পরিবর্তে নিজের কাছে থাকা ন্যূনতম মূল্যের যে কোনো জিনিসের বিনিময়েও সেবা নিতে পারবেন পিছিয়ে পড়া মানুষ। হাসপাতালের সমন্বয়ক জামাল উদ্দিন বলেন- দুর্গম পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মানুষ এখানে সেবা নিতে আসতে পারেন। যার কাছে হয়তো কোনো টাকা থাকলোনা তবে তার কাছে ঘরে ব্যবহৃত নতুন বা পুরনো যে কোনো জিনিন থাকতে পারে। সেটি দিয়েও তিনি এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেয়ার সুযোগ পাবেন। বিদ্যানন্দ মা ও শিশু হাসপাতালটি পুরাতন বিনিময় প্রথার মাধ্যমে গরীব মানুষকে চিকিৎসা দিতে যাওয়া দেশে প্রথম হাসপাতাল হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিদ্যানন্দের সদস্যরা। এ হাসপাতালে মাসে অন্তত ১০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে আশার কথাও জানিয়েছেন তারা।
সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্র্য মানুষের জন্য কিছু করার ব্রত নিয়েই বিদ্যানন্দ কাজ করছে জানিয়ে ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শিপ্রা দাশ বলেন, এ ধরনের একটি হাসপাতাল আমাদের স্বপ্ন ছিল। এখন সে স্বপ্ন বাস্তব। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে পেরে অসীম আত্মতৃপ্ত বলে জানান শিপ্রা দাশ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নওফেল বলেন, বিদ্যানন্দ মানবতার সেবায় অনুকরণীয় দায়িত্ব পালন করছে এবং করোনার সংকট মোকাবেলায় স্থাপিত কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল একটি মাইলফলক হয়ে আছে। তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষ যেন বিদ্যানন্দ হাসপাতালে বিনামূল্যে না হলেও খুবই স্বল্পমূল্যে সেবা পায় সেজন্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংটি বিদ্যানন্দকে প্রদান করা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ যাতে চিকিৎসা সেবা পায়, এ ধরনের সেবামূলক কাজে চট্টগ্রামবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যানন্দ ও এই হাসপাতাল একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন নওফেল।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এ হাসপাতালের অগ্রযাত্রায় সিটি কর্পোরেশন থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এ ধরনের কাজে বন্দর নগরীর বাসিন্দাদের সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অনুরোধও জানান তিনি।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, আউটডোর সেবার মাধ্যমে হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হলো। অল্প সময়ের মধ্যে ইনডোরসহ বাকি কার্যক্রমও চালু হবে বলে আশা করছি। এর মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত বিশাল একটি জনগোষ্ঠী অনেকটা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার সুযোগ পাবে বলে আমি মনে করি।
সভাপতির বক্তব্যে জুলহাস আলম বলেন,‘বিদ্যানন্দ একটি কনসেপ্ট, একটি ধারণা। অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ, সমতার বাংলাদেশ, দরিদ্র মানুষের এগিয়ে যাবার বাংলাদেশ, অবহেলিত শিশুদের যত্ন পাবার অধিকারের বাংলাদেশ, উপযুক্ত শিক্ষা পাবার বাংলাদেশ, দুস্থ মায়েদের চিকিৎসা পাবার বাংলাদেশ, নিরন্ন মানুষের খাবার পাওয়ার অধিকারের বাংলাদেশের একটি ধারণাই হলো বিদ্যানন্দ।
তিনি কর্পোরেট হাউজ, সমাজের বিত্তবান শ্রেণিকে বিদ্যানন্দের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিশ্ব দরবারে বিদ্যানন্দের নাম উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিদ্যানন্দ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। নতুন এই মা ও শিশু হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা দেশে এই প্রতিষ্ঠান সেবার ধারণা ছড়িয়ে দিবে বলে তিনি আশা করেন।