স্মরণ : প্রকৌশলী এএম মাহবুবুল ইসলাম

নুরুননেসা | বুধবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল ১৯শে নভেম্বর। আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান ও সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক এএম মাহবুবুল ইসলামের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। সে আমার ছোট ভাই। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতিতে আমার এ লেখা।
মানুষ কেন চলে যায়? কেন সে মরে যায়? কেন বড়জনের আগেই ছোটরা ছবি হয়ে যায়? আমি জানি না। আমি বুঝি না। আমার অন্তরটা শুধুই জ্বলে। বুকের ভেতরে কেবলই হুহু করে। সত্যি ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয়, মাহবুবের মতো এতো প্রাণবন্ত মিশুক ও পরোপকারী মানুষ কিভাবে আমাদের কে ফেলে অকালে চলে যেতে পারে! এই মুহূর্তে তাকে যে আমাদের ভীষণ প্রয়োজন ছিল।
আমরা ছিলাম পিঠেপিঠি ভাইবোন। ফলে বন্ধুত্বটাও ছিল বেশী। গাছ-গাছালি, পাখপাখালি ও বন-জংগলে পরিপূর্ণ টিলা উপরের বাড়িটার আনাচে-কানাচে দুজনে কারণে-অকারণে কত ছোটাছুটি করেছি, কত ধরনের খেলাধুলা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। সেসব মনে পড়লে এই অবুঝ মনটা ব্যথায় ভারী হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই কিছু কিছু বিষয়ে আমার সাথে বেশ মিল ছিল। একটু বড় হয়েও দুজনে একই রাজনৈতিক মতাদর্শে পথ চলেছি। তবে সে ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশী মেধাবী।
১৯৭৬ সালে মাহবুব চট্টগ্রাম প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে (বর্তমান চুয়েট) ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর বাসা থেকে হোস্টেলে চলে গেলে তার সাথে আমার সাময়িক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ১৯৮৬ সালে যখন সে টিএন্ডটিতে (বর্তমান বি টি সি এল) যোগদান করে তখন তার কর্মস্থল আর আমার কর্মস্থল কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা আবার বেড়ে যায়। সে প্রথমে কঙবাজার এবং পরে আগ্রাবাদ, নন্দনকানন এবং বেতবুনিয়া অফিসে কর্মরত ছিল। ঐসময়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হায়দারের অকাল মৃত্যু হলে সে প্রচণ্ড আঘাত পায়। ছাত্রজীবনের মতোই কর্মজীবনে ও সে অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছিল। সাংগঠনিক কাজকর্মেও ছিল মাহবুব অত্যন্ত চৌকস।
মাহবুব সব ধরনের লোভ-লাসার উর্ধ্বে থেকে পারিবারিক, সামাজিক অরাজনৈতিক জীবনে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। যে কোনো বিপদে-আপদে বা যে কোন জটিল সমস্যার সমাধান সুনিপুণভাবে অতি সহজেই সমাধা করে দিতে পারতো। ধনী-গরিব নির্বিশেষে কতো ধরনের মানুষের কতো যে উপকার সাধন করে গেছে তার কোন সীমা -পরিসীমা নেই। সে তার ডান হাত দিয়ে এমনভাবে দান করতো যে তার বাম হাত বলতে পারতো না। ২০০৯ সালে মা মারা যাওয়ার পর ২০১০ সালে সে সপরিবারে কানাডা চলে যায়। সেখানে থাকাকালীন আমাকে মাঝে মধ্যে ফোন করতো।
আলাপকালে কানাডার পরিবর্তিত পরিবেশে সে কেমন আছে বা তার সেখানে কেমন লাগছে তা কখনোই জানতে চাইনি। তবু্‌ও যতটুকু বুঝতাম সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধার কারণে গৃহিনীরাও দেশে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। দেশে থাকতেই ওর হার্টের ব্লকের কারণে দিল্লিতে চিকিৎসা করেছিল। মনে হয়, শরীরের প্রয়োজনীয় যত্ন-আত্তির বিষয়ে সে বোধহয় খুব ই উদাসীন ছিল। অত্যন্ত মিশুক ছিল বলে প্রবাসজীবনেও তার বন্ধুত্বের তালিকা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে থাকে। একসময়ে বন্ধুত্বের তালিকায় এ আর স্টার ট্রেকের কর্ণধার শাহীনুর ইসলাম তপনের নাম যুক্ত হয়- ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে/ অক্টোবরে সম্ভবত হার্টের ব্লকের কারণেই তাকে অকস্মাৎ টরেন্টোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একটু সুস্থ হলে সে তপনকে নিয়ে দেশে ফিরে আসে। কারণ তখন তার লিয়েনের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারির শেষে যখন সে ফিরে এসেছিল, তখন দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। ঐ সময়ে তাকে বেশ উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত দেখাতো। হয়তোবা চিরকালের চেনা-জানা পরিবেশে এসে, তার আপনজন, স্বজনদের কাছে পেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছিল তাইবা কে জানে। কিন্তু খোদাতায়ালার লীলাখেলা বোঝা বড়ই দায়!
মার্চের শেষে সে বনানীর টি এন্ড টি রেস্ট হাউসে থাকা অবস্থায় আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচন্ড জ্বর নিয়ে তাকে আনোয়ার খান মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। ১এপ্রিল সে কোমায় চলেযায়।এরপরের ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয় -বিদারক। তার অবস্থার কোনরকম উন্নতি না হওয়ায় তাকে ২০শে জুন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চিকিৎসার জন্য আবারও কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়। মাহবুবের জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে টরেন্টোর
জেনারেল হাসপাতালে। ঐসময়ে এবং তার জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি তপনের অসামান্য অবদান ছিল। দীর্ঘ সাতমাস অনেক কঠিন ও জটিল রোগভোগের পর আমাদের কে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে প্রাণপ্রিয় ছোট ভাই না ফেরার দেশে চলে যায়। একদিন না একদিনতো সবাইকেই চলে যেতে হবে।কিন্তু আমার ভালো মানুষ এবং সুন্দর মনের মানুষ ভাইটা যে আমাদের আগেই চলে যাবে তা কল্পনার অতীত ছিল। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা যেন আমার ভাইটিকে বেহেশত নসীব করেন।
লেখক : মরহুমের বড় বোন

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধসামাজিক যৌন-অনাচার নিয়ন্ত্রণে সোলন মাও ও বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা