শিশুদের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের সহিংসতা লেগেই আছে। নির্যাতনের ধরন আর নৃশংসতা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় মানুষকে পিটিয়ে লাশ করা হয়, তখনও কিছুই হয় না। শিশুদের ওপর চরম অত্যাচার চললেও কিছু হয় না। গবেষকরা বলেন, যে দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর সেরা আইন আছে, যে দেশে স্কুলে-মাদ্রাসায় শিশুর গায়ে হাত তোলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ, সে দেশেই শিশুরা মার খাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বলাৎকারের শিকার হচ্ছে নিজের বিদ্যাপীঠে, কাজের জায়গায়, বাড়িতে, পাড়ায়, চেনাজানা মানুষের হাতে, থানায় ও আদালত চত্বরে। তা নিতান্তই দুঃখজনক।
গত ১৩ই নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘শিশুর প্রতি এ কেমন নৃশংসতা’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নগরীর কোতোয়ালীতে ১১ বছর বয়সী এক শিশুকে পেটানোর পর পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে এক আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কোতোয়ালী থানাধীন পাথরঘাটার জলিলগঞ্জ আবাসিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ প্রথমে ওই শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। পরে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রুবেল সরদার (২৫) নামের এক অঙ্গীভূত আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সংবাদে আরো বলা হয়, বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জলিলগঞ্জ আবাসিক এলাকার একটি মাঠে আপনসহ কয়েকজন শিশু খেলছিল। খেলার এক পর্যায়ে মাঠের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেন। এ সময় সাথের অন্য শিশুরা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও আপনকে আনসার সদস্য রুবেল ধরে ফেলেন। প্রথমে লাঠি দিয়ে পেটানোর পর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এসময় কান্না ও চিৎকার শুনে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে আপনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ লোকজন আনসার সদস্য রুবেলকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের দেখলে এক ধরনের মায়া জন্মে। জগতের অন্য অনেক না পাওয়া, হতাশা ভুলিয়ে দেয় শিশুর নিষ্পাপ মুখ, তার অমলিন হাসি। সেই শিশুরা যখন নির্মম নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়-এরচেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। আর এ ধারণাই অপরাধীদের শিশুদের ওপর পাশবিক আচরণের অভয় দেয়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে। এ মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনো বিচারাধীন। এ ছাড়া যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ ধরনের নির্যাতনের মামলাগুলোর মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্নভাবে বেরিয়ে গেছে। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক। শিশুরা নিরীহ ও দুর্বল। এ জন্য সহজেই তারা টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তারা বিচার চাইতে পারে না। শিশু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার এটিও বড় কারণ। যে হারে শিশুহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ চলছে সেটা যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য অশনি সংকেত। একটি সভ্য সমাজ এভাবে চলতে পারে না।
সভ্য সমাজে শিশুর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় হত্যা, খুন অপহরণ, ধর্ষণ তো দূরের কথা। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও শিশুহত্যা নিষেধ। কিন্তু আমাদের সমাজে কেন এসব ঘটছে সেটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিগত দু’দশকে শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে; নেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের সামপ্রতিক দৃষ্টান্তের পরও দেখা যাচ্ছে নির্যাতন চলছেই। বিশেষ করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে সহিংসতার ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে শিশুরা অবলীলায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এই নৃশংসতার অবসান হওয়া প্রয়োজন।