ডিসেম্বরের মধ্যেই সংশোধন হচ্ছে দেউলিয়া আইন। খবরটি ঋণ গ্রহিতাদের জন্যে বিশেষ করে যারা খেলাপী করে বা বিশেষ করে যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী দেশে খেলাপী ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। ব্যক্তি চৌহদ্দি ছাড়িয়ে খেলাপী সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও বিস্তার লাভ করেছে। শুধু ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী নয়, অনেক বড় ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী নয়, অনেক বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও আজকাল ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনীহা আর্থিকখাতে খেলাপীঋণে রাশ টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া আইনের প্রয়োগ চাইছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। এ আইনে শুধু ব্যক্তি বা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া ঘোষণার বিধান থাকলেও করপোরেট দেউলিয়া ঘোষণার বিধান নেই। ফলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকা ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। উল্লেখ করা দরকার, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে কোম্পানির কাঠামোয় পরিবর্তন আসায় প্রাধান্য বাড়ছে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান-কোম্পানির চেয়ে করপোরেট ধরনের বড় বড় কোম্পানির। এসব প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে অসমর্থ হলে পাওনাদারের দায় মেটানোর এখতিয়ার বর্তমান আইনে অনুপস্থিত। এজন্য দেউলিয়া আইন সংশোধন করে ‘করপোরেট দেউলিয়াত্ব’ নামে নতুন একটা অনুচ্ছেদ সংযোজনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ করছে না,পাওনাদারের দায় মেটাচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে বিধানটি দ্রুত সংযোজন এবং এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি বড় ভূমিকা রাখবে বৈকি। লক্ষ্যণীয়, আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের একেবারেই যবনিকা ঘটে। অথচ আর্থিকভাবে বিপর্যয়ে পড়া সেসব প্রতিষ্ঠানকে একেবারে বন্ধ না করে পুনরায় চালু করার বিধান বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। দেশটিতে কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার আগে পাওনাদারের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সমঝোতা চুক্তির সুযোগ নিতে পারে। এ সুবিধা নিয়ে আদালতের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। আদালত প্রদত্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠন করতে না পারলে তারা দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার জন্য পুনরায় আদালতে আবেদন করতে পারে। এ ধরনের আইনগত সুবিধা নিয়ে দেশটিতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ঘুরে দাঁড়ানোর নজির আছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব এবং কর্মনিয়োজন উভয় দিক থেকেই সুফল প্রদায়ী। প্রতিষ্ঠান ভাঙা সহজ, কিন্তু গড়া কঠিন। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রস্থানের জন্য একটি মধ্যবর্তী আইনগত পরিসর থাকলে সেটি কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে ভালো কিছু করা সম্ভব। সুতরাং সংগত কারণেই দীর্ঘদিন ধরে দেউলিয়া আইনে এ ধরনের একটি বিধান সংযোজনের কথাও বলেছেন অনেকে। সংশোধিত আইনে বিধানটিও সংযুক্ত করার খবর মিলছে। ফলে কয়েকজন পাওনাদারের একসঙ্গে হয়ে অবসায়িত প্রতিষ্ঠানটির পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিতে পারবে। প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ও সুরক্ষা কবচ হতে পারে। বিদ্যমান দেউলিয়া আইন অনুযায়ী দেউলিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াসহ কিছু নাগরিক অধিকার হারায়। কিন্তু দেউলিয়া আদালতে ব্যাংকগুলো কয়েক হাজার মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হচ্ছে না। এতে আইনের কার্যকারিতা বা সুফল প্রশ্নবিদ্ধ। নতুন সংশোধনীতে দেউলিয়া আইনের ৯৪ ধারা সংশোধনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন আইনে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দকরণ বা বাতিল করা হবে। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ দাওয়াত দেয়া হবে না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। কোম্পানির পরিচালক কিংবা ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ কর, গাড়ি কেনায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। এছাড়া একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে। বলা যায়, শাস্তির বিধান আরো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হচ্ছে। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের কঠোর সংকেত প্রদান এবং খেলাপি ঋণ হ্রাস করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সময়ের আবর্তে বিশ্ব অনেক দূর এগোলেও দেশে এখনো পুরনো দেউলিয়া আইনের সংশোধন না হওয়ায় এটি যুগোপযোগিতা হারিয়ে গেছে। ফলে এর দুর্বলতাগুলোও বড় মাত্রায় পরিস্ফুট হয়েছে। যুগ চাহিদা মেটাতে অনেক দেশেই পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেউলিয়া আইনে এরই মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। এ প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আমাদেরও এ আইন সংশোধন জরুরি। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণে বিবেচ্য একটি সূচক হলো দেউলিয়া। নিষ্পত্তি আইনটি যুগোপযোগী করা হলে ব্যবসার পরিবেশ সহজিকরণ সূচকে আমাদের অবস্থান আগের চেয়ে উন্নতির আশা করছে সরকার।
অপ্রতুল দেউলিয়া আদালত ও মামলার নিষ্পত্তিতে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ না থাকায়, একই সঙ্গে অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে দেউলিয়া আইনটি কার্যকর করা যায়নি। এমত অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি, পাওনাদার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ অর্থঋণ আদালতে রাখতে যাচ্ছে সরকার। অর্থঋণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে দেনাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কোন দেনাদার অন্যায় করলেও রায় দেউলিয়া আদালতে পাঠাবেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেউলিয়া আদালত দেনাদারকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবেন। এজন্য অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ সংশোধনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দুটি আইনের সুসমন্বয় নিশ্চিত করা গেলে দুর্বলতা ও জটিলতা অনেকটাই দূর হবে। বিভিন্ন দেশের আইন পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে একটা যুগোপযোগী ও ত্রুটিমুক্ত দেউলিয়া আইন প্রণীত হোক-এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।