নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বিদ্যুৎ খাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, যখন নগরায়ন ও শিল্পায়ন অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে তখন উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে পরিকল্পনা বজায় রাখা বিদ্যুৎ খাতের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিদ্যুৎ নিয়ে আসল পরিকল্পনা প্রায়ই পরিবর্তন করতে বাধ্য হতে হয় বলে জানান তাঁরা। তাঁরা আরো বলেন, যখন এমন অপরিকল্পিত উন্নয়ন হয় তখন ভবিষ্যতে বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে পূর্বানুমান করা কঠিন। তাঁরা অর্থনৈতিক এলাকা উন্নয়নে সরকারের নেওয়া সামপ্রতিক পরিকল্পনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন। যদিও বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে। ১১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা অনেকটা স্বপ্ন মনে হলেও নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। এই বছরের ডিসেম্বর বা অল্পকিছু দিন পরে মুজিববর্ষের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হবে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলেই মাত্র ১১ বছরেই বিদ্যুৎ খাতে বড় বিপ্লব ঘটেছে।
বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৫ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোড শেডিং শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে এই শতভাগ বিদ্যুতের লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদি নিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদার জোগান দেওয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিদ্যুৎ বিভাগকে এগোতে হচ্ছে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সাফল্যের দৃষ্টান্তও রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
পাওয়ার সেলের তথ্য মতে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭টি। মাত্র ১১ বছরেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। ১১ বছর আগে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখ। সঞ্চালন লাইন যেটা ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, সেটা এখন ১২ হাজার ২৮৩ সার্কিট কিলোমিটার। গ্রিড সাবস্টেশনের ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ, সেটা বেড়ে এখন হয়েছে ৪৫ হাজার ১৯৪ এমবিএ। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার কিলোমিটার। ১১ বছর আগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১০ কিলোওয়াট ঘণ্টায়। এখন বিতরণ লস : ৯.৩৫ শতাংশ। গত ২৯ মে ২০১৯ দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন রেকর্ড হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট।
বর্তমানে দেশের ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎসুবিধা পাচ্ছে। সরকারের রূপকল্পে ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর। কিন্তু এক বছর এগিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট ৫ বা ৩ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় এনে মুজিববর্ষেই শতভাগ বিদ্যুৎ ঘোষণা করা হচ্ছে। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
আসলে ‘সবার ঘরে বিদ্যুৎ’ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এ সফলতার ‘নেপথ্য নায়ক’। তাঁর সময়োপযোগী, দূরদর্শী, সাহসী ও কার্যকর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের বিদ্যুৎ খাত অতি অল্প সময়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং কর্মকর্তারাও এই সাফল্যের অংশীদার বলে মনে করি আমরা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জে সফলতার জন্য আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে অভিনন্দিত করছি। এবার চাই বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চ্যালেঞ্জ।