বেড়েছে মশা, নিধনে নেই গতি

চসিকে ওষুধ আছে, বরাদ্দও মিলেছে নগরে এডিস মশার উপস্থিতি, লার্ভিসাইড ছিটানোর পরামর্শ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১১ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

ওষুধের সংকট নেই। মিলেছে সরকারি বরাদ্দ। আছে জনবল। পর পর দুদিন আনুষ্ঠানিকতাও হয়েছে। তবু গতি পাচ্ছে না চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মশক নিধন কার্যক্রমে। অথচ শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় শহরজুড়ে বেড়েছে মশার উৎপাত। এর মধ্যে গত মাসে পরিচালিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে নগরের বেশিরভাগ বাসায় মিলেছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ‘এডিস’ মশার উপস্থিতি। এছাড়া দিনরাত ফাইলেরিয়ার জীবাণুবাহী কিউলেক্স মশার অত্যাচার তো আছেই। এদিকে কীটতত্ত্ববিদরা মশার ডিম ধ্বংসকারী ওষুধ লার্ভিসাইড ছিটানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন নালা-নর্দমায় এবং স্থির থাকা পানিতে এ ওষুধ ছিটানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। চসিকের স্টোরে পর্যাপ্ত লার্ভিসাইড মজুদ আছে। এরপরও নতুন করে ১৫ হাজার লিটার কালো তেল (এলডিও ও এইচএসডি) কিনছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মশার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় নালা-নর্দমায় জমাট হয়ে আছে পানি। সেখানে ডিম ছাড়ছে ফাইলেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণুবাহী মশা। বর্ষায় অতি বৃষ্টির ফলে এসব ডিম বা লার্ভা ধ্বংস হয়ে যায়। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি জমাটবদ্ধ থাকায় ধ্বংস হয় না।
কিলবিল করছে মশা : শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, খাল ও নালা-নর্দমায় কিলবিল করছে মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা। মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে খাল-নালায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে পানি চলাচল বন্ধ। এসব আবদ্ধ পানিতে বেশি কিলবিল করতে দেখা গেছে।
এডিসের উপস্থিতি : নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে গত মাসে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা নিয়ে জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জরিপে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, আমি যে ওয়ার্ডে গেছি তার প্রত্যেকটায় এডিস মশা পেয়েছি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সাত-আটটি করে এডিস মশা পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি নালাপাড়ায় সিপিআই ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে একটা ভবনে প্রচুর এডিস মশা পাওয়া গেছে। সাংঘাতিক অবস্থা ছিল সেখানে। এছাড়া সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে পেয়েছি।
এদিকে নগরে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে ১৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সিভিল সার্জন অফিস। এর বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গতি পাচ্ছে না চসিকের কার্যক্রম : ৪ নভেম্বর মশক নিধন কার্যক্রমের আওতায় মশার প্রজনন রোধে নগরে খাল পরিষ্কার কর্মসূচি শুরু করে চসিক। ওইদিন বাকলিয়ায় বির্জা খাল থেকে আবর্জনা ও বর্জ্য পরিষ্কার করা হয়েছিল। ৬ নভেম্বর মাস্টার পোল এলাকা থেকে ওষুধ ছিটানোর আরেকটি কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন বিভাগের দাবি, প্রতিটি ওয়ার্ডকে চারটি জোনে ভাগ করে প্রতিদিন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
তবে নগরবাসীর অভিযোগ, এলাকায় তারা পরিচ্ছন্নকর্মীদের দেখছেন না। কেবল পত্রপত্রিকায় ওষুধ ছিটানোর কথা শুনছেন। আজাদীর পক্ষে রহমতগঞ্জ, মুরাদপুর মোহাম্মদপুর, লাভলেইন, আতুরার ডিপো, এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া, দামপাড়া এক নম্বর গলি, হেমসেন লেইন, কাপাসগোলা, আসকারদিঘিসহ অন্তত ২০টি এলাকার বাসিন্দার সাথে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন তো দূরের কথা, কয়েক মাসেও সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে ওষুধ ছিটাতে দেখেননি।
সংকট নেই তবু সংগ্রহ : ডেঙ্গু মোকাবেলা ও পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য গত ৫ অক্টোবর চসিককে ১ কোটি টাকা দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ১৮ আগস্ট পরিচ্ছন্ন বিভাগের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন পর্যন্ত চসিকের স্টোরে ১২ হাজার ২৮৬ লিটার এডালটিসাইড এবং ১০ হাজার ৭৪৮ লিটার লার্ভিসাইড মজুদ আছে। পরিচ্ছন্ন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ৯ হাজার লিটার লার্ভিসাইড ও ১০ হাজার লিটার এডালটিসাইড মজুদ আছে।
বিভাগটির আগের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, প্রতি ২০ মিলিলিটার লার্ভিসাইডের সাথে ১০ লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করা হয়। সে আলোকে ৮টি হ্যান্ড স্প্রে মেশিন দিয়ে দৈনিক প্রতি ওয়ার্ডে ৮০০ মিলিলিটার লার্ভিসাইড ছিটানো যাবে। অর্থাৎ এক বছরে প্রতি ওয়ার্ডে ২ হাজার ৯২ মিলিলিটার বা ২৯২ লিটার লার্ভিসাইড প্রয়োজন, যা ৪১ ওয়ার্ডের জন্য হবে ১১ হাজার ৯৭২ লিটার। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে লার্ভিসাইড ছিটানো হয় না। তাই চাহিদা আরো কমে যাবে। ওই হিসেবে চসিকে বর্তমানে লার্ভিসাইডের সংকট নেই।
এদিকে লার্ভিসাইডের সংকট না থাকলেও ১৫ হাজার লিটার কালো তেল সংগ্রহ করছে সংস্থাটি। অবশ্য ৪ মে ২১ হাজার লিটার কালো তেল সংগ্রহ করে। বর্তমানে এর কোনো মজুদ নেই।
কীটতত্ত্ববিদের বক্তব্য : চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস আজাদীকে বলেন, ড্রেনগুলোতে পানি জমে আছে। সেখানে কিউলেঙ মশার বিস্তার বাড়ছে। ড্রেনের নোংরা পানিতে কিউলেঙ মশা বেশি হয়। যদিও এ মশা কামড়ালে যে রোগ হয় সেটা চট্টগ্রামের দিকে হয় না। শুষ্ক সময়ে কিন্তু এডিস মশার বিস্তার কমে যাবে এবং বর্ষায় বাড়বে।
কিউলেঙ মশা থেকে রক্ষায় কী করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কিন্তু বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত বেশি। সবগুলোর সাথেই ড্রেনের সংশ্লিষ্টতা আছে। ড্রেনগুলো যদি প্রতিদিন পরিষ্কার করা যেত, তাহলে মশার উপদ্রব বাড়ত না। প্রত্যেকে যদি একটু সচেতন হয়ে নিজ নিজ বাসা-বাড়ি, ড্রেন পরিষ্কার করে, অনেক বেশি উপকার হবে। তাছাড়া এখন কিন্তু নালায় স্প্রে করার উপযুক্ত সময়। মশার লার্ভা মারার মৌসুম এখনই। বর্ষাকালে নালায় স্প্রে করে লাভ হয় না। কারণ বৃষ্টির পানিতে সেগুলো চলে যায়।
তিনি বলেন, লার্ভিসাইড ছিটালে বেশি ভালো হয়। আর না হলে কালো তেল দেওয়া যাবে। যেকোনো তেল পানির উপর ভাসে। কালো তেলও ভাসবে। মশা ডিম ছাড়তে গেলে পানির উপর কালো তেলের আবরণটা দেখবে। তখন তেলের উপর ডিম ছাড়বে না। ওই জায়গা থেকে কালো তেলের সুবিধা আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী এডালটিসাইডের চেয়েও লার্ভিসাইড বেশি কার্যকর হবে। যেটুকু সময় ও টাকা খরচ করে এডাল্ট মশা মারা যাবে, তার চেয়ে কম সময়ে অধিক সংখ্যক লার্ভা ধ্বংস করা যাবে। যেমন এক ঘণ্টায় একশ অ্যাডাল্ট মশা মারা গেল। কিন্তু এক ঘণ্টা যদি নালা-নর্দমায় লার্ভিসাইড ছিটায়, তাহলে লক্ষ লক্ষ লার্ভা ধ্বংস করা যাবে। ডিমও মরে যাবে।
চসিকের বক্তব্য : চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, মশক নিধন কার্যক্রম চলমান আছে। বির্জা খাল পরিষ্কার করতে চার-পাঁচদিন লেগেছে। আগামী শুক্রবার ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে আকমল আলী রোডের খালটি পরিষ্কার করব। এভাবে ৪১ ওয়ার্ডে চলবে। আমাদের টার্গেট হচ্ছে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নির্মূল করা। আমরা প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের দিকে জোর দিচ্ছি। আজ পদ্মা থেকে ১৫ হাজার লিটার তেল (কালো তেল) নিয়েছি।
তিনি বলেন, পদ্মা থেকে যেটা নিচ্ছি সেটা খুব কার্যকরী। এটা ছিটালে মশার প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের কাছে লার্ভিসাইড আছে। সেটাও ছিটাচ্ছি।
পরিচ্ছন্নকর্মীদের ওষুধ না ছিটানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছিটাচ্ছে। ওয়ার্ডের মধ্যে যেখানে যেখানে লার্ভা আছে সেখানে ছিটানোর জন্য তাদেরকে বলেছি। তিনি বলেন, খাল খনন প্রকল্পের জন্য পানি আবদ্ধ হয়ে আছে। সেটা উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সমস্যা থাকবে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি, যেখানে যেখানে অপরিচ্ছন্ন আছে তা পরিষ্কার করে ওষুধ ছিটাতে। ইনশাল্লাহ কাজে গতি আসবে। ক্যারাভান কর্মসূচিতেও মশক নিধন অন্তর্ভুক্ত করব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্ধ কোটি টাকার স্বর্ণসহ পাচারকারী আটক
পরবর্তী নিবন্ধদায়িত্ব পালন না করলে ডোর টু ডোর শ্রমিকদের নিয়োগ বাতিল : সুজন