দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্য সরকার বার্ষিক ৩০ লক্ষ টন পরিশোধন সক্ষমতার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) নির্মাণ উদ্যোগের ১০ বছর পার হলেও এখনো ভৌত কাজের কিছুই হয়নি। মূলত সম্ভাব্য ব্যয় নিয়ে ভারতীয় প্রজেক্ট কনসালট্যান্ট ও ফ্রান্সের ভৌত ঠিকাদারের মধ্যে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার অসামঞ্জস্য তৈরি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। বেশি ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে পরবর্তীতে আর্থিক অনিয়মের সমালোচনা উঠতে পারে বর্তমান কর্মকর্তাদের কাঁধে। এজন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয় বিরাজ করছে। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিদেশি সাপ্লাইয়ার ও প্রাইভেট উদ্যোক্তাদের অদৃশ্য বাধার অভিযোগও রয়েছে। বিপিসি বলছে, ইআরএল-২ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়বে। এতে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি কমবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ও রোধ হবে। সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি। ১৯৬৬ সালে নগরীর গুপ্তখাল এলাকায় ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। ফ্রান্সের টেকনিপ প্লান্টটি নির্মাণ করে। ইস্টার্ন রিফাইনারির এই ইউনিটটির সক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এই রিফাইনারি থেকে দেশের মোট চাহিদার ২৫ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা হয়। বর্তমানে জ্বালানি সক্ষমতা ও নিরাপত্তা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারির বর্তমান স্থাপনার মধ্যে ৩০ লাখ মেট্রিক টন সক্ষমতার ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ প্রকল্পটি হাতে নেয় বিপিসি। বিপিসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির অভ্যন্তরেই নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। তবে শুরুর দিকে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হলেও পরবর্তীতে সংশোধিত হয়ে ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসাল্ট (পিএমসি) হিসেবে নিয়োগ পায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১০ সালের দিকে প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রকল্পটির জন্য ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি সই করে বিপিসি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর উপস্থিতিতে চুক্তিসই অনুষ্ঠান হয়। ওইদিন মন্ত্রী বলেছিলেন, পরবর্তী বছরের মধ্যেই ইআরএল-২ প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হবে। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছরেও প্রকল্পের মূল কাজ শুরু সম্ভব হয়নি। কখন শুরু হবে, তার উত্তরও কারো কাছে নেই। তাছাড়া ২০১৮ সালের ৭ মে চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারির সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ওই সময়ে দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় আড়াই বছরেও শুরু না হওয়ায় মন্ত্রীর আশ্বাস নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ইআরএল-২ প্রকল্পটি চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। এতে মোট চাহিদার ৭৫ ভাগ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। ইআরএল-২ এর মাধ্যমে ফিনিশড প্রডাক্ট হিসেবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, জেট এ-১, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেজ অয়েল, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার পাওয়া যাবে।
অভিযোগ উঠেছে, ব্যক্তিখাতে পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি করতে বেসরকারি কয়েকটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। ইআরএল-২ দ্রুত ও নির্ধারিত সময়ে নির্মিত হলে ব্যক্তিখাতের রিফাইনারির যেমন প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে না, তেমনি বিপিসিকে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাবে। থাকবে না।
সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, ইআরএল-২ প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই ব্যক্তিখাতের রিফাইনারি অনুমোদন নিতেই প্রকল্পটির ডিপিপি অনুমোদনসহ নানা প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রকল্পের ব্যয় কিছুটা বাড়ছে। প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা দাড়িয়েছে। সময়ও বাড়ছে। আগে যেখানে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় ছিল। এখন ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।’
এদিকে প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় নিয়ে পিএমসি (প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট) ঠিকাদার ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ইআইএল) সাথে ফ্রান্সের ভৌত ঠিকাদার টেকনিপ’র মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকার অসামঞ্জস্যতা দেখা দেওয়ার কারণে নতুন জটিলতার তৈরি হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ইআইএল প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করেছে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশী টাকায় (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসেবে) ১৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। কিন্তু টেকনিপ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার প্রস্তাবনা করেছে। যা বাংলাদেশী টাকায় ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ইআইএল প্রকল্পটি করতে ওয়ান পয়েন্ট এইট বিলিয়ন ডলার সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আমরা যখন টেকনিপের কাছ থেকে প্রস্তাবনা চেয়েছি, তারা প্রজেক্টটি করতে টু পয়েন্ট এইট বিলিয়ন ডলার দাবি করছে। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার তফাৎ’। এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সরকারি চাকুরি করি। কিন্তু জ্বালানি খাতে বড় বড় মাফিয়ারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। টেকনিপ একটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান। তারা ইস্টার্ন রিফাইনারির বর্তমান প্লান্টটি করেছিল ১৯৬৭ সালে। ৩০ বছর মেয়াদ ধরা হলে ১৯৯৭ সালে প্লান্টটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ শেষের ২৩ বছর হয়েছে, এখনো চলছে। তাদের কাজের গুণগত মান বজায় থাকে। কিন্তু পিএমসি ঠিকাদারের ব্যয় প্রস্তাবনার সাথে টেকনিপের প্রস্তাবনার বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমরা যদি এখন টেকনিপকে কাজ দিয়ে দিই; তাহলে অনেকে আমাদের পেছনে লাগবে। তখন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠবে। কিন্তু প্রজেক্ট না হলে সেই অভিযোগ উঠার কথা নয়।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইআরএল-২ নির্মিত হলে বাংলাদেশ জ্বালানি নিরাপত্তার দিকে অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখন অনেক জায়ান্ট ইনভেস্টররা পুরোদস্তুর রিফাইনারি করতে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছে। তারা চান না সরকারি রিফাইনারি হোক। আবার বর্তমান সরবরাহকারীরাও চান না সরকারি রিফাইনারি হোক। তাহলে আমাদের ফিনিসড অয়েলের চাহিদা কমে যাবে। এতে তাদের ব্যবসাও কমে যাবে। যে কারণে পরোক্ষ বিরোধিতা তৈরি হচ্ছে।’
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী মো. রাশেদ কাউছার মঙ্গলবার দুপুরে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ইআরএল-২ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল) ও টেকনিপের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে। ইআইএল তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর টেকনিপও তাদের প্রস্তাবনা দিয়েছে। ইআইএলের সাথে আমাদের চুক্তি গত বছর শেষ হয়ে গিয়েছিল। গত আগস্ট পর্যন্ত তারা আর কোনো কাজ করেনি। এখন তাদের সাথে আমাদের চুক্তিটি নতুন করে রিনিউ (নবায়ন) করা হয়েছে। তারা প্রস্তাবনাটি নতুন করে রিভিউ (পুনঃমূল্যায়ন) করছেন। ইতোমধ্যে ইআইএল, টেকনিপ ও ইআরএল যৌথভাবে বেশ কয়েকটি মিটিং করেছে। এখনো মিটিং চলমান রয়েছে।’ ত্রিপক্ষীয়ভাবে সমঝোতার পরই প্রকল্পের মূল কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।