দেশের প্রায় সব খাতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও প্রবাসী আয় ও কৃষি উৎপাদনে তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদন বলছে, কোভিড-১৯ পরিণতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বড় গন্তব্য প্রায় সবকটি দেশেই রেমিট্যান্সপ্রবাহ নেতিবাচক ছিল। এ সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে ভারত, শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়ারও। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মেঙিকো ছিল ব্যতিক্রম। শুধু তা-ই নয়, প্রবাসী আয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে দেশ তিনটি। করোনার মধ্যেও রেমিট্যান্সপ্রবাহ ও রিজার্ভের স্ফীতি অন্যতম সুখবর হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও দেশীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বানুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তারা আভাস দিয়েছিল, মহামারীর কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমে যাবে। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে দিয়ে আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি একদিকে দেশের অর্থনীতিতে আশার সঞ্চার করেছে। অন্যদিকে আবার এ আয় বৃদ্ধির ধারায় বাহিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। বর্তমানে পরিস্থিতি আমাদের ভিন্ন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। করোনার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা জমানো টাকা পাঠিয়েছেন। অনেক দেশে আবার টাকা পাঠানোর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে আগামী কয়েকমাসে প্রবাসী আয় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
করোনার কারণে সারা বিশ্বে পুরো অভিবাসন খাতটা সংকটে পড়েছে। তবে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব ও অবদানের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের অভিবাসনের বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে এ মুহূর্তেই আলোচনা করতে হবে। এর মধ্যে যারা দেশে ফিরে এসেছেন তাদের কোন কাজ নেই আয়ের উৎসও নেই। এই প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। সহজ শর্তে উদ্যোক্তা ঋণ প্রদানসহ তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে। করোনা শুরু হওয়ায় পর পরই আমাদের জনশক্তির রপ্তানি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া কোন দেশেই এখন শ্রমিক নিতে পারছে না, এমনকি ভিসা পাওয়ার পরও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে যেতে পারছেন না। কয়েক হাজার শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। দেশে এখন অনেক শ্রমিক-কর্মচ্যুত তারা নতুন চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছে না।
প্রবাসী আয় ধরে রাখতে হলে জনশক্তি খাতের এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের করোনা পরবর্তী কৌশল বা লক্ষ্য কি তা নির্ধারণ করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদেরও একটি বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। সেই প্রতিযোগিতার জায়গাটা হলো দক্ষ কর্মী তৈরি। এটা ঠিক যে একটা সময় ছিল, যখন দক্ষ কর্মী না হলেও চলতো। জনশক্তি প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান অদক্ষ শ্রমিক কেউ বা কোন প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয় না।
কোভিড-১৯ এর অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করতে বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতেও পারে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। মার্চ-এপ্রিল ২০২০ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক গতি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহ দেখা গেছে। যা কোভিড-১৯ এর কারণে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবাহ সত্ত্বেও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে সহায়তা করছে। তবে জ্বালানি তেলের দরপতন ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে এক ধরনের অশ্চিয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা ও প্রবাসীরা অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে অনিশ্চয়তা সবসময়ই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের নতুন উৎস খুঁজতে হবে। পাশাপাশি বিদেশ গমণেচ্ছুদের দক্ষতাবৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
গন্তব্য ও উৎস দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শ্রমবাজার স্বাভাবিক হবে না। গন্তব্য দেশগুলোতে এরই মধ্যে কিছুটা উন্নতি হলেও আমাদের দেশে হয়নি । এটি বিলম্বিত হলে শ্রমবাজার চালু আরো হুমকির মুখে পড়বে। আটকে পড়া প্রবাসীদের কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছানোর পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার খোঁজা নিতান্তই প্রয়োজন।
এজন্য বিদেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগী হতে হবে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নির্দেশনা বা নীতিমালা ঠিক করে দিতে পারে। পুরনো শ্রমবাজারের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে করোনা পরবর্তী সময় কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার আশংকা রয়েছে। এর জন্য এখন থেকেই এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়ে গর্ব করার যে সুযোগ প্রবাসীরা করে দিয়েছেন সেই ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট থাকাটা জরুরি। আমাদের প্রবাসীরা একটু সহায়তা পেলে নিজেদের মেধা ও শ্রম দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে পারেন, তা প্রমাণিত। এখন সরকার প্রমাণ করতে হবে তারাও প্রবাসীদের সহায়তা করতে প্রস্তুত।