অনেক উৎকণ্ঠার পর ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। তুমুল লড়াই আর অনেক তিক্ততার পর ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য পেনসিলভেনিয়ায় জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার রানিং মেট কমলা হ্যারিস প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে বহু আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেওয়া রিপাবলিকান দলের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনের অবসান ঘটলো। নির্বাচিত হওয়ার পর জো বাইডেন বলেছেন, এখন আমেরিকাকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ করার সময়, ‘সারিয়ে তোলার’ সময়। নজিরবিহীন বাধার মধ্যেও এ নির্বাচনে রেকর্ড ভোট পড়ার বিষয়টি তুলে ধরে বাইডেন বলেছেন, আমেরিকার হৃদয় গভীরে যে গণতন্ত্রের চেতনাই স্পন্দিত হয়, এটা তার প্রমাণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিবাসী পিতা-মাতার সন্তান নিম্ন-মধবিত্ত পরিবারে পেনসিলভেনিয়ার স্কেনট্রনে-এ জন্ম নেয়া জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশকে বহু সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের যে উল্টোমুখি যাত্রা তার থেকে ভিন্ন পথে – সামনের দিকে অগ্রসর হবার সম্ভাবনার সূচনা হল। পথ বন্ধুর, অতীতের সবটাই উদযাপনের মতো নয়, সংকট গভীর কিন্তু এই মুহূর্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের জন্যে ঐতিহাসিক। এই মুহূর্ত সম্ভাবনার, প্রত্যাশার।
বাইডেনের জয়ের ফলে বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে চারদিকে। জো বাইডেন নির্বাচনী প্রচারের সময়ই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হওয়া মাত্র জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কার্যক্রম এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনবেন। সে হিসেবে আশা করা যায়, বিশ্ব সংস্থার যে জায়গাগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র সামপ্রতিক সময়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, সেখানে আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে সমহিমায় ফিরিয়ে আনবেন বাইডেন। ডেমোক্রেট পার্টির ফোরামে তিনি বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে চীনের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন। তিনি ‘কো-অপারেশন অ্যান্ড কম্পিটিশন’ বা ‘সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা’র নীতি চীনের ক্ষেত্রে নিতে চান। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবির বলেছেন, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের একটি অংশ বাংলাদেশ। সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ কিন্তু এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। এ কারণেই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে যে ব্লু-ইকোনমি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যে বাধাগুলো আছে, তা চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর দুই থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছয় থেকে সাত বিলিয়ন রপ্তানি করে মাত্র। এটা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটা খোলা অর্থনীতি। জো বাইডেন যদি এই খোলা অর্থনীতির দরজা আরও প্রসারিত করেন তবে সুযোগ আরও বাড়বে। আরও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স আয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অভিবাসী আছেন অনিয়মিত। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল তাদের জন্য কঠোর। জো বাইডেন আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ অনিয়মিত অভিবাসীকে নিয়মিত করবেন। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিরাও উপকৃত হবেন এবং রেমিট্যান্সেও একটা প্রভাব পড়বে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়, চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে। জো বাইডেন নির্বাচিত হলে যদি যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের অবসান হয় তাহলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে এবং সেখানে ভারতকে পাওয়াও সহজ হবে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে।
তবে জো বাইডেন কতটা কাজ করতে পারবেন, তারজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা চাই তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র সুস্থ চিন্তাধারায় এগিয়ে চলুক এবং অন্যদেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হোক।