চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কার্যক্রমের দৃশ্যমান গতি নেই। বর্তমানে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, আপিল কমিশনারেট ও উচ্চ আদালতে রাজস্ব সংক্রান্তসহ বিভিন্ন মামলা আছে প্রায় ৯ হাজার। মামলার জট কমাতে গত ২০১২ সালে এডিআর কার্যক্রম শুরুর নির্দেশনা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এডিআরের কার্যক্রম সন্তোষজনক না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সব কাস্টম হাউসকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমসের এডিআর শাখার কর্মকর্তারা জানান, এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির জন্য গত দুই বছরে একটি আবেদনও জমা পড়েনি। অর্থাৎ কোনো আমদানিকারকই আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে কোনো এক পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। এখানে আসলে কেউ ছাড় দিতে চায় না। অন্যদিকে এডিআরের কার্যক্রম জোরদার করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউসকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর।
চট্টগ্রাম কাস্টসের এডিআর শাখা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উচ্চ আদালতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের মামলা আছে ৪ হাজারেরও অধিক। এছাড়া আপীলাত ট্রাইব্যুনালে গত ৫ নভেম্বর পর্যন্ত মামলা রেকর্ড হয়েছে ৪ হাজার ৮৫০টি এবং আপিল কমিশনারেটে মামলা আছে ১৭০টি। এসব মামলার মধ্যে সব মামলা আবার এডিআরে নিষ্পত্তির শর্ত পূরণ করে না। এদিকে কাস্টম হাউসগুলোতে এডিআর কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে চিঠি লিখেছে এনবিআর। সংস্থাটির সদস্য (শুল্ক রপ্তানি, বন্ড ও আইটি) সুলতান মাহমুদ ইকবাল স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, গত ৮ সেপ্টেম্বর এনবিআরের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে শুল্ক ও মূসক অনুবিভাগের বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর) কার্যক্রমের ওপর একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বলা হয়-আমদানি পণ্যের শুল্কায়নকালে পণ্যের মূল্য, শুল্ককরের পরিমাণ, অর্থদণ্ড, জরিমানা, আমদানিকারক কর্তৃক স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিলাদি দাখিল না করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কাস্টম হাউসগুলোতে অসংখ্য মামলার জট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ, আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বা আপিল কমিশনারেটে চলমান আছে। এসব মামলার কারণে সরকারের বিশাল অংকের রাজস্ব আটকা পড়ে আছে। এসব মামলা সাথে জড়িত রাজস্ব দ্রুত সরকারের তহবিলে আনার লক্ষ্যে শুল্ক (বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি) বিধিমালা, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়।
চিঠিতে আরো বলা হয়, মাঠ পর্যায়ে এডিআর বিষয়ক প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- গত ২০১১-১২ অর্থবছরে এডিআর প্রথা চালু করার পর থেকে গত জুলাই ২০২০ পর্যন্ত কাস্টমস অনুবিভাগের আওতাধীন ৬টি কাস্টম হাউসে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা আশানুরূপ নয়। বর্তমানে কাস্টম হাউস সংশ্লিষ্ট ১৫ হাজার ৭৭৭টি মামলা বিভিন্ন দপ্তর, আপীলাত কর্তৃপক্ষ ও সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। মামলার জট কমানো ও সরকারের ন্যায্য রাজস্ব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদায়ে এডিআর সূচনা করা হয়। এছাড়া দি কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯ এর সেকশন ১৯২ তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো বিরোধ বিকল্প উপায়ে সমঝোতার ভিত্তিতে নিস্পত্তি করা হলে উক্ত সমঝোতার বিরুদ্ধে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা কর্তৃপক্ষের নিকট আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না। দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এডিআরের মাধ্যমে মামলার নিস্পত্তির আবেদনকারী, সহায়তাকারী ও বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থেকে সততা-বিশ্বস্ততার সাথে সমঝোতার মনভোব নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। আইনে সুস্পষ্ট বিধান থাকা স্বত্ত্বেও এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিস্পত্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই আইনের বিধান মতে, সংশ্লিষ্ট সকলকে এডিআর কার্যক্রম জোরদারে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ প্রদান করা হয়।
কাস্টমস সূত্র জানায়, উচ্চ আদালত ও কাস্টমসের আপিল ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘদিন থেকে নিষ্পন্ন না হওয়া অবস্থায় রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয় এনবিআর। সেই লক্ষ্যে গত ২০১২ সালের ১ মার্চ থেকে কার্যক্রমটি শুরু হয়।তবে বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহযোগিতায় ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে এডিআর পদ্ধতি গতি পায়। এ পদ্ধতিতে আদালতের বাহিরে আমদানিকারক ও কাস্টমসের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একজন নিরপেক্ষ সহায়তাকারীর মাধ্যমে দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিআর কার্যক্রম চালু রাখতে হলে কাস্টমস ও আমদানিকারক উভয় পক্ষকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল এডিআর কার্যক্রম গতি পাবে। সহায়তাকারীরা আইনি ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। এছাড়া এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হলে কাস্টমস ও আমদানিকারক উভয়পক্ষ লাভবান হবে।
এবিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার (এডিআর শাখা) মো. আব্দুল আলীম দৈনিক আজাদীকে বলেন, এনবিআরের নির্দেশে আমরা এডিআরের কার্যক্রম জোরদারে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন এডিশনাল কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার স্যারকে এডিআরের বিভাগীয় প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করা হয়। বিরোধপূর্ণ মামলার আমদানিকারকদের তালিকা তৈরি করে তাদের সাথে যোগাযোগ করছি। তাদেরকে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিস্পত্তির জন্য উদ্বুব্ধ করার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আমদানিকারকদের এগিয়ে আসতে হবে।