হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | সোমবার , ৯ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন : ট্রাম্পের পরাজয়, গণতন্ত্রের জয়

সমস্ত জল্পনা-কল্পনা, আশংকা আর টানটান উত্তেজনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হলেন জো বাইডেন, পুরো নাম জোসেফ আর বাইডেন। নির্বাচনের পাঁচদিন অধীর অপেক্ষার পর অবশেষে এলো কাঙ্ক্ষিত বিজয়। তবে হোয়াইট হাউসের চাবি পেতে তাকে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি তক অপেক্ষা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বিজয়ী হলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী, জো বাইডেন আর তার সহযোগী ভাইস প্রেসিডেন্ট সিনেটের কমলা হ্যারিস। তাদের এই বিজয়ের চাইতে যেটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই জয়ের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের আপাতত রক্ষা পাওয়া। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো গণতান্ত্রিক বিশ্ব। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা এবং শাসনক্ষমতা কার কাছে তার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে বিশ্ব রাজনীতি ও নানা ইস্যুতে পরিচালিত বৈশ্বিক নীতি। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। গত চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে আমরা দেখেছি এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি কী ভাবে গোটা বিশ্বের মানচিত্র মন্দের দিকে অনেকটা বদলে দিয়েছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্রের আপাততঃ রক্ষা’ বলছি এই কারণে, চার বছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘প্রেতাত্মা’ যে আবার উঠে আসবেনা সেটি এই মুহূর্তে হলফ করে বলা যায় না। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শেষ হবার আগেই বাতাসে সংবাদ উড়তে লাগলো যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুত্র, এরিক ট্রাম্প, যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাইতে আর এক ধাপ এগিয়ে উগ্র ও বদ, আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। যদিও বা দল তাতে কতটুকু সম্মত হবে সেটি দেখার বিষয়। তবে রিপাবলিকান দল ও এর নেতারা এটি খুব ভাল করে জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বিশাল ভোট-ব্যাংক আছে যা তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্যে প্রয়োজন হতে পারে। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে গেলেও ভোট পেয়েছেন রেকর্ড পরিমাণ, প্রায় ৭০ কোটির উপর, অন্যদিকে জো বাইডেন পেয়েছেন প্রায় ৮ কোটি। ট্রাম্পের রেখে যাওয়া আমেরিকায় এমন মারাত্মক রাজনৈতিক ‘পোলারাইজেশন’ বা বিভাজন আর আগে দেখা যায়নি। জনগণের মাঝে তিনি খুব সফলতা ও দক্ষতার সাথে বিভাজন সৃষ্টি করতে পেরেছেন। গত চার বছর তিনি দেশ শাসন করেছেন বৃটিশদের মত ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি দিয়ে। তিনি একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি তার হলো না।
জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জিতলেও তাদের আগামী দিনগুলো ‘বন্ধুর’ ও ‘চ্যালেঞ্জিং’। প্রথমত ডোনাল্ড ট্রাম্প এতো সহজে ক্ষমতা ছাড়ার পাত্র নন। সেটি তিনি অনেক আগ থেকেই জানান দিয়েছিলেন এবং জো বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর তার অতি ঘনিষ্ঠ মিত্র, ৯-১১ সময়কার নিউ ইয়র্কের মেয়র রুডলফ গুলিয়ানি এই ঘোষণা অবৈধ বলে সুপ্রিম কোর্টে যাবার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে জো বাইডেনকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেবার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে মিথ্যে জয় দাবি করছেন জো বাইডেন। বৈধ ভোটই নির্ধারণ করবে প্রেসিডেন্ট কে হবে, গণমাধ্যম নয়। এই নির্বাচনের এখনো অনেক বাকি’। দেখা যাচ্ছে তার মাঝে এখনো ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘টোন অব ডিফায়েন্স’। নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনে যিনি হেরে যান তিনি ক্ষমতার ‘ট্রান্সজিশন পিরিয়ডে’ হবু প্রেসিডেন্টকে নানা বিষয় বুঝিয়ে নিতে সহায়তা করেন। এখন দেখার বিষয় ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ব্যাপারে জো বাইডেনকে কতটুকু সহায়তা করেন। তবে এটি লক্ষ্য করার বিষয় যে প্রাক-নির্বাচন সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখেছিলেন। প্রাক-নির্বাচনী নানা জরিপে বলা হয়েছিল জো বাইডেনের ‘ভূমিধস বিজয়’ হবে। কিন্তু না, তেমনটি ঘটেনি। হেরে গেলেও ট্রাম্প রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। ধারণা করা হয়েছিল হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং সিনেটেও বিশাল জয় ছিনিয়ে নেবে ডেমোক্রেটিক পার্টি। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কোনভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে সক্ষম হলেও সিনেটে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেলেও প্রমাণ করলেন, আমেরিকানদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা কোনভাবেই খাটো করে দেখার বিষয় নয়। এক হিসাবে তিনি সঠিক। কেননা তিনি গোটা নির্বাচন লড়েছেন এককভাবে। মিথ্যের উপর গড়ে উঠা তার ‘বুলি’ তিনি কোটি কোটি আমেরিকানদের ‘গেলাতে’ সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তার পাশে তার স্ত্রী, পরিবারের সদস্য এবং হাতে গোনা কয়েক দলীয় নেতা ও কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে জো বাইডেনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেমেছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জনপ্রিয় গায়িকা লেডি গাগার মত অনেকেই। বারাক ওবামা একটি পর একটি গণসংযোগ করেছেন বাইডেনের পক্ষে, কোথায়ও একা, কোথায়ও বাইডেনের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে। বারাক ওবামা এমন কী ফোন করে ভোটারের সাথে নিজে কথা বলেছেন এবং বাইডেনের জন্যে ভোট চেয়েছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে রিপাবলিকান দলের বাঘা বাঘা নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। সবাই তার কাছ থেকে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন নিজেদের আসন ঠিক রাখার জন্যে। একমাত্র ফক্স নিউজ ও কিছু আঞ্চলিক মিডিয়া ছাড়া সিএনএন, এবিসি সহ মূলধারার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল তার বিপক্ষে। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভোট গণনার শেষ পর্যায়ে দেখা গেল ফক্স নিউজ তার (ট্রাম্প) পক্ষে তাদের এতদিন-ধরে মিথ্যে প্রচার করা বন্ধ করে দিল। নির্বাচনের দিন কয়েক পর হোয়াইট হাউসে তিনি যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে মিথ্যাচার শুরু করেন, তখন টিভি চ্যানেলগুলি তার বক্তব্য প্রচার সাথে সাথে বন্ধ করে দেয় এই অভিযোগ এনে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমানে মিথ্যাচার করছেন যা তারা বলেন, সঠিক নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, জালভোট দেয়া হয়েছে, তার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে – তার এমনতর বক্তব্য রিপাবলিকান দলের অনেক নেতাও ভালোভাবে নেননি এবং তারা প্রেসিডেন্টকে এই মিথ্যাচার বন্ধ করার আহবান জানিয়ে সত্যকে গ্রহণ করার আহবান জানান। কথা হলো, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। এদিকে দলের শীর্ষ নেতা ও ঘনিষ্ঠজনেরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। ভোট গণনায় জালিয়াতির অভিযোগ নিজ দলেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এ নিয়ে রিপাবলিকান দলে চরম মতভেদ দেখা দিয়েছে।
নানা কারণে এবারের নির্বাচন ছিল উল্লেখযোগ্য ও ঘটনাবহুল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে গোটা বিশ্বে এমন উৎসাহ আর আগ্রহ আগে আর কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। এই প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন সত্তোর্ধ্ব দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ৭৪, অন্যদিকে দিন কয়েক আগে জো বাইডেন বয়স হলো ৭৮। আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হলেন। কেবল তাই নয়, প্রথম শ্বেতাঙ্গ মহিলা। তার পুরো নাম কমলা দেবী হ্যারিস (৫৬)। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মহিলা একজন সফল আইনজীবী ও সিনেটর। কমলার মা, শ্যামলা গোপালন ১৯৫৮ সালে ১৯ বছর বয়সে উচ্চতর পড়াশুনা করার জন্যে ভারতের তামিলনাড়ু থেকে আমেরিকায় আসেন। কমলার স্বামী ডগলাস এমহফ একজন আইনজীবী। বলছিলাম বাইডেন ও ট্রাম্পের কথা – দু’জনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য- কী চিন্তা-ভাবনায়, কী কর্মকাণ্ডে। ভোট গণনা শেষ হবার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দিতে থাকেন।
বেচারা ট্রাম্প! একে একে সবাই তাকে ছেড়ে চলেছে। মজার বিষয় হলো, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মেনে নেবেন না এবং সুপ্রিম কোর্ট যাবেন বলে ঘোষণা দেন, সেই মুহূর্তে রিপাবলিকান দলের প্রথম সারির অনেক নেতা জো বাইডেনকে তার বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রিপাবলিকান দলের পক্ষ হয়ে ২০১২ সালে বারাক ওবামার কাছে হেরে যাওয়া, সিনেটর মিট রমণি। জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি টুইটারে লেখেন, ‘আমিও এন (স্ত্রী) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা জানি তারা দুজনেই ভালো মনের ও প্রশংসনীয় চরিত্রের’। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ছোট ভাই, ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর জেব বুশ, বাইডেনের উদ্দেশ্যে লেখেন, ‘আমি আপনার সফলতার জন্যে প্রার্থনা করতে থাকবো’। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের বিপক্ষে লড়ে হেরে গিয়েছিলেন। অভিনন্দন শুভেচ্ছায় ভাসছেন বাইডেন আর কমলা। ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন ও হিলারি ক্লিনটন, জিমি কাটার পৃথকভাবে তাদের অভিনন্দন জানান। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের অনেকে তাদের অভিনন্দন জানান। তাদের মধ্যে অন্যতম ফরাসি প্রেসিডেন্ট মেক্রন ও জার্মানির চ্যান্সেলর মের্কেল। হিলারি ক্লিনটন তার বার্তায় লেখেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক রায় এবং ট্রাম্পের প্রতি অস্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকায় নতুন এক অধ্যায় সূচিত হলো’। আসলেও তাই, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হলো এবং বলার অপেক্ষা রাখে না, সে অধ্যায় আগামী প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার জন্যে কঠিন। বাইডেন এমন এক সময় প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন যখন গোটা বিশ্ব এক মহামারীর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং যে মহামারীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ নাগরিক মৃত্যু বরণ করেন এবং প্রায় এক কোটি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। লক্ষ লক্ষ আমেরিকান বেকার, জলবায়ু, বর্ণবাদ, বিভক্ত জাতি, আন্তর্জাতিক বলয়ে ট্রাম্পের কারণে হারানো বন্ধুত্ব, মিত্র শক্তিদের মাঝে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষা, যা ট্রাম্পের এক-চোখা নীতির কারণে স্থবির হয়ে পড়ে আছে- এমনিতর নানাবিধ সমস্যা। এই সবকিছু সামাল দেয়া যে কঠিন কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন দেখার বিষয় জো বাইডেন কী ভাবে এই সব সমস্যার সামাল দেন। তার কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। বিশ্বের প্রত্যাশাও কম নয়। ট্রাম্প গত চার বছরে জাতির মাঝে যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন, যে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন তাকে সারানো তার প্রধান কাজ। এই পাহাড়-সম কাজে কতটুকু সক্ষম হবেন সেটি এখন দেখার বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত আরও ১০৩ জন