বাজার অর্থনীতির এ যুগে সরকার পরিচালিত ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রসঙ্গে

রেজাউল করিম স্বপন | রবিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বের সব দেশেই মানুষের করের টাকায় সরকার পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজ করা হয়।এক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন বাজেটে ভাটা পড়ে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যেমন কয়েকদিন আগে আগ্রাবাদ টিএন্ডটি অফিসে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম টিএন্ডটিতে আগের সেই জৌলুস ও প্রাণচাঞ্চল্য নেই। জানতে পারলাম বর্তমানে ল্যান্ডফোনের ডিমান্ড নোটের টাকা মাত্র পাঁচশত। আরো জানলাম আবেদনের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে লাইন পাওয়া যায়। টিএন্ডটি টেলিফোন এতো সহজলভ্য হয়ে গেছে শুনে অবাক হলাম। মনে পড়লো ১৯৯০ সালের কথা, আমার বাসায় ল্যান্ড টেলিফোন আনার জন্য বেশ কয়েকবার টিএন্ডটির আগ্রাবাদ অফিসে গিয়েছিলাম। তখন অফিসিয়ালি টেলিফোন লাইন দেওয়া বন্ধ ছিল। মন্ত্রীর রিকমেন্ডেশন হলে লাইন পাওয়া যায়, না হলে নয়। সেই রকম কোন মন্ত্রীর সাথে সম্পর্ক না থাকায় বাধ্য হয়ে একজন লাইন ম্যানের সাথে কন্ট্রাক্ট করলাম। প্রায় দুই মাস পর সে আরেকজনের নামের একটা টেলিফোন পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে বাসায় লাগিয়ে দেয়। শুরু হলো ফোনের বিড়ম্বনা। কখনো শো শো আওয়াজ, কখনো ডায়ালটোন পাওয়া যায় না, কখনো রং নাম্বারে কানেকশন আবার কখনো প্যারালাল কানেকশন হয়ে যায়। অর্থাৎ অনেক রকমের সমস্যা। সমাধানের জন্য সার্ভিস নাম্বারে ফোন করলে, কখনো মেরামত করতে লোক আসতো আবার কখনো আসতো না। তাদেরকে জামাই আদর করে আনতে হতো। কাজ শেষে ৩০০ হতে হাজার টাকা পর্যন্ত বকশিস দিতে হতো। তাদের অজুহাতের অভাব ছিলো না। কখনো বলতো লাইনের তার নষ্ট। কখনো বলতো ডিপি বঙে লাইন খালি নাই, দূরের বঙ হতে লাইন আনতে হবে তাই তারের দাম দিতে হবে। কখনো বলতো সেট নষ্ট আরো কত কি। পরবর্তীতে দেশে বেসরকারিভাবে মোবাইল ফোন নিয়ে এলো সিটিসেল। তারা এসে প্রথমে ১-১.৫ লাখ টাকায় ফোন বিক্রি করলো।এতো টাকা দিয়েও ফোন নেওয়ার জন্য মানুষ লাইন ধরতো।এভাবে কয়েক বছর চলার পর আসলো গ্রামীনফোন ও এ কে টেল। তারাও প্রথম প্রথম ১-১.৫ লাখ টাকায় ফোন বিক্রি করলো, তাও সীমিত আকারে।সেই ফোনের জন্যও মানুষ দিনে রাতে কোম্পানিগুলোর অফিসের সামনে কিউ দিয়ে বসে থাকতো। আস্তে আস্তে মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে লাগলো। গ্রাহকও বাড়লো এবং দামও কমতে থাকলো। বেসরকারি ফোনের নেটওয়ার্ক যত বিস্তৃত হতে থাকলো টিএন্ডটি ফোনের উপর নির্ভরতা তত কমতে শুরু করলো এতে করে টিএন্ডটির আয়ও কমতে থাকলো। পরে টিএন্ডটি মোবাইল কোম্পানিগুলোর মত মোবাইল ফোন ‘টেলিটক’ নিয়ে এলো। বর্তমানে টিএন্ডটির মোবাইল ফোন অন্যান্য বেসরকারি মোবাইল ফোনের সাথে টিকতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ মানুষ চায় সার্ভিস। যেটা টেলিটকে পাওয়া যায় না। তাই টি এন্ড টির দাপট একেবারেই কমে গেছে। এখন মানুষ ল্যান্ডফোন ব্যবহার করে না। যাদের ল্যান্ডফোন আছে তারাও ফোন ছেড়ে দিতে চায়। কারণ হলো মানুষ ফোন নিয়ে অযথা ঝামেলায় জড়াতে চায় না। যদি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো ব্যবসায় না আসতো, তবে টিএন্ডটি ফোনের জ্বালায় মানুষ এখনো অতিষ্ঠ থাকতো। শুধু কি টিএন্ডটি? দেশের সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা একই। যেমন আগে মানুষ চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য নির্ভর করতো সরকারি ডাক বিভাগের উপর। তখন চিঠিপত্র পাঠিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতো। কখনো সময়মত পৌঁছাতো আবার কখনো পৌঁছাতো না। ডক্যুমেন্ট না পৌঁছালেও কিছু করার ছিল না। কারণ জবাবদিহিতা ছিল না। পরবর্তীতে দেশে বেসরকারি বিভিন্ন ক্যুরিয়ার সার্ভিস আসলো। তারা দ্রুত সেবা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করলো। মানুষ এখন সরকারি ডাকে ডকুমেন্ট পাঠায় না, ক্যুরিয়ার সার্ভিসে পাঠায়।এই সুযোগে ক্যুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সরকারি ডাক বিভাগ এখন টিকে আছে শুধু সরকারি ডক্যুমেন্ট আদান প্রদান ও সরকারের বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে। অথচ ডাক বিভাগের অফিস সারা দেশে বিস্তৃত, তবুও বেসরকারি ক্যুরিয়ার সার্ভিসের সাথে ব্যবসায় পেরে ওঠে না।
সরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির অবস্থা আরো করুণ। খেয়াল করলে দেখবেন, এর বহরে কয়েক বছর পর পর ২০০-৩০০ নতুন বাস যোগ করা হয়।এরপরেও তারা সারা বছর লোকসান দেয়। অথচ বেসরকারী বাস কোম্পানিগুলো পরিবহন ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। মাঝে বিআরটিসিতে দামি ভলবোর বাস আনা হয়েছিল। যেগুলো এখন রাস্তায় চোখে পড়ে না। নষ্ট হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় গ্যারেজে পড়ে আছে।এভাবে সরকারের শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন বিআরটিসির এতো করুণ দশা? এই কথা বলার কেউ নেই।
কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, দেশের চিনিকলগুলোর চিনি অবিক্রিত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে। দেশের চিনির চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে বেসরকারি উৎপাদন কারী কোম্পানিগুলো। তারা বাজারে সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারছে না। আর সরকারি চিনিকলগুলোর চিনি অবিক্রিত থাকে। অথচ সরকারি চিনিকল গুলোর বেশিরভাগ চিনি সরবরাহ করা হয় সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কাছে। যৎসামান্য তারা বাইরে বিক্রি করে। কিন্তু সেটাও তারা বিক্রি করতে পারে না বেশি দাম নির্ধারণের কারণে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে দেখবেন তারা বছরের পর বছর লোকসান দেয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে। বলতে পারেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কেন এমন হয়? এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমার বাসা ও অফিসের বিদ্যুতের মিটারের রিচার্জ করতে হয় সরকারি ও বেসরকারি দুই জায়গা থেকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে এক হাজার টাকা রিচার্জ করলে মিটারে ব্যালেন্স এক হাজার টাকা পাওয়া যায়। আর সরকারি এলাকার মিটারে এক হাজার টাকা রিচার্ড করলে ব্যালেন্স পাওয়া যায় ৮০০/-। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করলে বলে, ওনাদের করার কিছু নাই। এটা সেন্ট্রালি সেট করা। তাহলে এক হাজার টাকা রিচার্জ করলে ব্যালান্স হয় ৮০০ টাকা, এর প্রতিকার কার কাছে পাওয়া যাবে? মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে পণ্যের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করলেই শুধু লোকসান দেয়। তাই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সরকারের নতুন করে চিন্তা করা উচিত। কারণ জনগণের টাকায় সরকার উন্নয়ন করতে চাইলেও এ-সব প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকির কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ গণপ্রকৌশল দিবস, গণমুখী প্রযুক্তিই-গণমানুষের মুক্তি
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে