নিত্যনতুন কৌশলে অপরাধে কিশোর গ্যাং

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

চলার পথে ধাক্কা লাগায় মো. ফয়সালকে (১৬) থাপ্পড় দেয় হালিশহরের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান লিটন (৫০)। অসাবধানতাবশত ধাক্কা লাগলেও দোষারোপ করে লিটনের থাপ্পড় দেয়ার বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে পারেনি ফয়সাল। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেয়ার। শেষ পর্যন্ত একা পেয়ে লিটনকে এলোপাথারি ছুরিকাঘাতে খুন করে ১৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে। ১৯ অক্টোবর হালিশহর থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে খুনের বিষয়টি।
এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, বর্তমানে নগরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাং। একদিকে তাদের তালিকা পরিবর্তন, পরিবর্ধন চলছে, অন্যদিকে চলছে কিশোর গ্যাং লিডারদের গ্রেপ্তারে অভিযান। পাশাপাশি থানায় থানায় বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কিশোরদের অভিভাবকদের সাথে চলছে পুলিশের মতবিনিময়। তবে এতকিছুর পরও নগরীতে দিন দিন শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। নিত্যনতুন কৌশলে চুরি-ছিনতাই ও খুনের ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে কিশোর অপরাধীর সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে।
সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অভাবকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশ কাজ করছে। কিন্তু কিশোর অপরাধ নির্মূলে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন জোরদার করতে হবে। সামাজিক অনুশাসন যেটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেটাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে যে তারা সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে পারছেন না। অনেক অভিভাবকদের দেখি কোন প্রয়োজন ছাড়া সন্তানদের মোটরসাইকেল দিচ্ছেন। সেই মোটরসাইকেল পুলিশ আটক করলে তদবির করতে আসেন। সন্তানকে মোটরসাইকেল দেয়ার কারণ জানতে চাইলে অভিভাবক বলেন ‘সন্তান আবদার করেছে, তাই দিয়েছি’। কিন্তু সন্তানের এই অনৈতিক আবদার রক্ষা করতে গিয়ে তাকে যে বিপথে ঠেলে দিচ্ছেন তা একবারও ভাবছেন না। অনুসন্ধানে জানা যায়, কিশোর গ্যাং চট্টগ্রামে নতুন বিষয় নয়। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি জামালখান এলাকায় কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য প্রকাশ্যে আসে। ওই ঘটনায় তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বর্তমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর ১৬টি থানায় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করার নির্দেশ দেন। ঐ বছর ছোট বড় কিশোর গ্যাং এর ৫৫০ জন কিশোর তালিকাভূক্ত হয়। এছাড়া নগরীর ৩০০টি স্পটকে এসব কিশোরের আড্ডাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরের বছর ২০১৯ সালে নগরীতে এসব গ্যাং কালচারে জড়িত কিশোরের সংখ্যা ছিল মোট ৫৩৫ জন।
এরমধ্যে কোতোয়ালী থানায় সর্বোচ্চ ১৫০ জন কিশোর এসব গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত থাকার কথা জানা যায়। কিন্তু পতেঙ্গা ও কর্ণফুলীতে এরকম কোনও কিশোর গ্যাংয়ের নাম উঠে আসেনি ওই তালিকায়। এছাড়া আড্ডাস্থল চিহ্নিত হয় ২৩০টি। কোচিংভিত্তিক, রাজনৈতিক, স্কুল-কলেজভিত্তিক, চাকরিজীবী এই ধরনের অন্তত ১৫টি ক্যাটাগরির তালিকা করা হয়েছিল। তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ এবং খুলশী এলাকা নিয়ে গঠিত সিএমপির উত্তর জোনে। এখানে অন্তত ১২৫টি আড্ডাস্থল রয়েছে। কোতোয়ালী, সদরঘাট, চকবাজার এবং বাকলিয়া নিয়ে গঠিত দক্ষিণ জোনে রয়েছে ১০৫টি আড্ডাস্থল। পুলিশ কিশোর গ্যাং এর ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক ও গডফাদারের তালিকা করে। এরমধ্যে ১৭ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, ৫ জন সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের পদধারী নেতা। ১৩ জনের দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা প্রভাবশালী। বাকি ১১ জন পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় টপটেরর। পুলিশের অভিযানে গত বছরের শেষ দিকে কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা কমে আসে। কিন্তু চলতি বছরে কথিত ‘বড় ভাই’দের ছত্রছায়ায় এদের দাপট আবারো বেড়েছে। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে প্রায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করা হয়। পাশাপাশি অন্তত ১৫ জন লিডারকে আটক করা হয়। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছ থেকে ছুরি, আগ্নেয়াস্ত্র, রড, মাদক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়।
সিএমপির অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, কিশোর অপরাধী ও আড্ডাস্থলের যে তালিকা আগে করা হয়েছিল, সেটিকেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে নতুন তালিকা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী অভিযান চলছে, গ্যাং লীডাররা গ্রেপ্তার হচ্ছে।
পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, অভিযানে গ্যাং লিডারদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আমরা বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অভিভাবকদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ পুলিশী অভিযানে অপরাধী ধরা পড়বে। কিন্তু মা-বাবা সচেতন হলে সে অপরাধ জগতে পা রাখতে পারবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিযানে চসিক, তিন শতাধিক সাইনবোর্ড উচ্ছেদ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে নতুন শনাক্ত ৯৪