দেশে নানা ক্ষেত্রে তথ্যগত বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। এবার বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বহির্মুখী প্রত্যক্ষ বিষয়টি সামনে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এখন পর্যন্ত বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ ৩০ কোটি ডলার। অথচ ‘মার্কিন ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস অ্যাফেয়ার্সের সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২০ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট স্টেটমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ৩০০ কোটি ডলারের উপরে। বলা যেতে পারে সরকারের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তথ্যে ১০ গুণের বেশি ফারাক। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ এখনো খুব সীমিত হলেও এত বড় তথ্যগত ব্যবধান কেন হলো তা খতিয়ে দেখা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই কাজটি করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মার্কিন দপ্তরটিকে তথ্য বিনিময়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে যে তাদের তথ্যের উৎস কী এবং কীভাবে সংগ্রহ করেছে। এভাবে এগুলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে এবং অবৈধ পন্থায় অর্থের বহির্গমন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া সহজতর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে দেশের বেশ কিছু শিল্পগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগ করেছে। মূলত এসব তথ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কাছে রয়েছে। এর বাইরে অনানুষ্ঠানিক পন্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগের খবর মিলেছে। যার কোন তথ্য সরকারি সংস্থার কাছে নেই এটা উদ্বেগজনক। দেশ থেকে এভাবে অননুমোদিতভাবে অর্থ চলে গেলে অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। কাজেই এর একটা বিহিত করা একান্তই আবশ্যক। ওয়াশিংটন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টো্ল্লগ্রিটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে উদ্বেগজনক মাত্রায় অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও নিয়মিত বিরতিতে এ সংক্রান্ত তথ্য উঠে আসছে। অনানুষ্ঠানিক পন্থায় বিনিয়োগের আড়ালে আসলে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সেটিও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিকভাবে কোথায় কোথায় বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটি সন্ধান করা অত্যাবশ্যক। এতে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। বড় কথা, এর মাধ্যমে এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে হওয়া বিনিয়োগগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উপায় বের হতে পারে। এতে বিদেশে অর্জিত বাংলাদেশিদের মুনাফা থেকে দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি অর্থপ্রবাহের সঞ্চার হবে। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার একটা সন্তোষজনক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। এটি ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী এটা ইতিবাচক। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে নেতিবাচক পরিবর্তন এলে তা সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমদানি দায় মেটাতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তার ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতভাবে বিদেশে অর্থের বহির্গমন চলতে থাকলে সেটিও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে সামস্টিক আর্থিক স্থিতিশীলতায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিষয়টিকে হালকা করে নেয়ার সুযোগ নেই। শুধু বিনিয়োগের আড়ালে নয় নানা পন্থায় দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থের বহির্গমন হচ্ছে। এক্ষেত্রে শক্ত আইন থাকলেও প্রয়োগজনিত দুর্বলতায় তাতে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশমুখী বৈধ ও অবৈধ অর্থ প্রবাহ নিয়ে এখনো নিবিড় কোনো গবেষণা হয়নি, যার ভিত্তিতে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি সার্বিক ধারণা মেলে। বিশ্ব ব্যাংকের কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি গবেষণার কাজ চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইতিবাচক এ উদ্যোগ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক।
এটা ঠিক যে আজ যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ও রফতানির বাজার তা আগের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। দেশে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা সক্ষম কোম্পানির সংখ্যাও বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে তারা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে মুনাফাযোগ্যতা বিবেচনায় বিদেশের মাটিতে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে আগ্রহী। এটাকে অবমূল্যায়ন করা সমীচীন হবে না। বৈধ সুযোগ সীমিত হলে অবৈধ পথ অবলম্বনের প্রবণতা বাড়ে। অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় এটি প্রমাণিত। জানা গেছে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য এরই মধ্যে একটা খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার ও বিনিময় হারে অভিঘাতসহ অর্থনৈতিক সার্বিক সুফল পর্যালোচনা করে এটি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা জরুরি। সর্বোপরি বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের এখানে ধরে রাখতে উন্নত, মসৃণ ও ঝামেলাহীন একটি বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো যায়, তার একটি পথনকশাও দরকার। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া যেতে পারে।