চল্লিশ বছরেও শেষ হয়নি অপেক্ষা

কবে ক্ষতিপূরণ পাবেন নুর ছেহের

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

ভিটেবাড়ি হারানোর পর চল্লিশ বছর ধরে ক্ষতিপূরণের টাকার আশায় দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন বন্দর এলাকার এক বৃদ্ধা। নানাজনের দুয়ারে গেছেন, অভিযোগ দিয়েছেন। দুদকের শুনানিতেও কষ্টের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভোগের অবসান হয়নি।
অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয় দাবি করে বলেছে, বিষয়টি জেলা প্রশাসনের। বন্দর কর্তৃপক্ষ হুকুম দখলকৃত জায়গার পুরো মূল্য জেলা প্রশাসনকে প্রদান করেছে। জেলা প্রশাসন তাদের জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে। এক জায়গার জন্য দুইবার টাকা প্রদানের সুযোগ বন্দরের নেই। অপরদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে বৃদ্ধার টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায় ছয়জনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক মামলা দায়ের করেছেন।
জানা যায়, ১৯৮০-৮১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এমপিবি ইয়ার্ড নির্মাণের সময় নিউমুরিং তক্তারপুল এলাকায় বেশ কিছু ভূমি হুকুম দখল করে। ওই সময় ওই এলাকার ফজল সুকানির বাড়ির আলিম উল্ল্যাহর দশমিক ৮১ শতাংশ জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার শুরুতে নিজের পুত্র সন্তান জন্মের দুদিন আগে হাফেজ মাওলানা আলিম উল্ল্যাহ মারা যান। তার স্ত্রী নুর ছেহের বেগম একমাত্র পুত্র এবং দুই কন্যাকে নিয়ে ভিটেমাটি এবং মাথা গোঁজার ঠাঁই হারালেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
এ বিষয়ে নুর ছেহের বেগম বিভিন্ন সময় নানা জনের দুয়ারে ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণের অর্থ কিংবা পুনর্বাসন কোনোটাই হয়নি। তিনি ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামের সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা (১০৩/৯০) করেন। ১৯৯০ সালে ওই মামলায় নুর ছেহেরের পক্ষে ডিক্রি দেন আদালত। ওই ডিক্রিতে আলিম উল্ল্যাহর ওয়ারিশদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে আলিম উল্ল্যার পিতা সুলতান আহমেদের পক্ষে স্বাক্ষর জাল করে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নেওয়া হয়। ওই ক্ষতিপূরণ স্ট্রাকচার বাবদ ছিল দাবি করে আলিম উল্ল্যাহর পুত্র মিজানুর রহমান গতকাল আজাদীকে বলেছেন, স্ট্রাকচারের ক্ষতিপূরণ স্বাক্ষর জাল করে তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারটি রয়েছে। এই ব্যাপারে বন্দর আইন উপদেষ্টার একটি পত্রেও তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে মতামত দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়, ওই রায়ে নুর ছেহের বেগম গংকে তাদের কাছে অধিগ্রহণকৃত ভূমির সমপরিমাণ ভূমি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন ভূমিতে পুনর্বাসন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দশ বছর গত হলেও এই মতামত বাস্তবায়িত হয়নি।
অপরদিকে দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় (এলএ মামলা নম্বর ৯৩/৮০-৮১) পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি আলিম উল্ল্যার নামীয় কতটুকু জমি হুকুম দখল করা হয়েছে এবং মূল্যসহ স্থাপনার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও কতটুকু পরিশোধ করা হয়েছে তা জানানোর জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (এলএ) কাছে অনুরোধ জানান বন্দরের উপ-ব্যবস্থাপক (ভূমি) জিল্লুর রহমান। কিন্তু এই পত্রের ব্যাপারেও বেশি অগ্রসর হয়নি। ভূমির ক্ষতিপূরণ আলিম উল্ল্যাহর ওয়ারিশদের পরিবর্তে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে।
জীবনের একটি বড় অংশ বিভিন্ন দফতরে ধর্না দিতে দিতে বৃদ্ধা হয়ে গেছেন নুর ছেহের বেগম। তিনি নানা রোগে আক্রান্ত। হার্টের অসুখ আছে। দেনা করে হার্টে রিং বসানো হয়েছে। তার পুত্র মিজানুর রহমান বন্দরের সিকিউরিটি বিভাগে গার্ড হিসেবে চাকরি করেন। তাদের কষ্টের কোনো সীমা নেই উল্লেখ করে গতকাল নুর ছেহের বেগম জানান, আমার জীবন তো শেষ। এখন একমাত্র ছেলেটির মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই স্বস্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারব।
আদালতের রায় এবং দুদকের শুনানির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কষ্ট করে দুদকের শুনানিতে দুঃখের কথা বলেছিলাম। দুদক তিন মাসের মধ্যে আমাদের পুনর্বাসন করার কথা বলেছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও আমাদের জন্য কেউ কিছু করেননি।
এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-ব্যবস্থাপক (ভূমি) জিল্লুর রহমান বলেন, এখানে বন্দরের কোনো দায় নেই। কিছু করারও নেই। নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো সংস্থা ভূমির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনে আবেদন করে। জেলা প্রশাসন সার্ভে করে ভূমির মূল্য এবং স্ট্রাকচারের ক্ষতিপূরণ বাবদ কত টাকা দিতে হবে তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানায়। ওই সংস্থা ভূমির মূল্য এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ জেলা প্রশাসনকে প্রদান করে। জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ভূমি মালিকদের টাকা পরিশোধ করে অধিগ্রহণকৃত ভূমি প্রত্যাশী সংস্থাকে বুঝিয়ে দেয়। এখানে প্রত্যাশী সংস্থার কোনো ধরনের দায় থাকে না।
তিনি বলেন, আলিম উল্ল্যাহর ভূমির মূল্যও বন্দর কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন জেলা প্রশাসন ওই টাকা কাকে দিয়েছে বা দেয়নি তা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিবেচনার সুযোগ নেই। আবার একই জমির ব্যাপারে দুইবার টাকা পরিশোধেরও সুযোগ নেই। বিষয়টি সুরাহা করবে জেলা প্রশাসন।
নুর ছেহের বেগমের পুত্র মিজানুর রহমানকে বন্দর কর্র্তৃপক্ষ সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে বন্দরে চাকরি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। তবে মিজানুর রহমান গতকাল আজাদীকে বলেন, আমি এতিম এবং আনসার-ভিডিপি কোটায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন গতকাল আজাদীকে বলেন, বিষয়টি অনেক আগের। আমি এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। এছাড়া নুর ছেহের বেগম যদি আমার কাছে আসেন, তাহলে প্রয়োজনীয় সহায়তা করব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইয়াবার পর মিয়ানমার থেকে এবার আসছে স্বর্ণের চালান
পরবর্তী নিবন্ধজেল হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন জিয়া : তথ্যমন্ত্রী