বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় আগ্রাবাদ এলাকায়। আছে দেশের প্রধান তেল বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কার্যালয়। আগ্রাবাদের পাশ্ববর্তী এলাকা সদরঘাট। এলাকাটি নৌঘাট ও বন্দরের ট্রান্সপোর্ট জোন এলাকা। অথচ নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের জনপদ। প্রায় ঘটে সংঘর্ষ, একের পর এক হত্যাকাণ্ড। গ্রুপে গ্রুপে অস্ত্রের ছড়াছড়ি। গতবছর দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে এখানকার ত্রাস যুবলীগ নেতা ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী খোরশেদ র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। তবুও কিঞ্চিৎ পরিমাণ কমেনি অপরাধ।
চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘাট দখলসহ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে পাঁচজনের বিরুদ্ধে। তারা হলেন- ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, যুবলীগ নামধারী মোস্তফা কামাল টিপু, খলিলুর রহমান নাহিদ, জহির উদ্দিন বাবর ও এস এম পারভেজ। তারা সবাই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দলীয় পদ পদবী নেই, তবুও তারা নেতা! অথচ আইনশৃংখলা বাহিনীর খাতায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বিপদজনক ও ত্রাস সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত। এই পাঁচ নেতা কিশোর গ্যাং গডফাদার হিসেবেও পরিচিত।
আগ্রাবাদ গণপূর্ত ভবন নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায় সংঘর্ষ লেগেই থাকে। গতবছর ৪ এপ্রিল সিজিও বিল্ডিংয়ের ২য় তলার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সামনে দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দরপত্র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাদের উভয়ের মধ্যে মারামারি ও সরকারি ভবনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ। এরপর ২৪ এপ্রিল ফের প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে বিদেশি পিস্তলসহ চার কিশোরকে আটক করা হয়। একই বছর কোরবানি ঈদের পরের দিন আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সোহেল নামে এক যুবককে।
২০১৬ সালের ১ নভেম্বর ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রুপ। অস্ত্রহাতে দুই গ্রুপের দুই সন্ত্রাসীর ছবি পত্রিকার শিরোনাম হয়। সেই অস্ত্রধারীরা ছিল- ফয়সাল আহমেদ রাজ (লিমন গ্রুপ) ও সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন (পারভেজ গ্রুপ)।
আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি ও গণপূর্ত ভবনের ত্রাস যুবলীগ নামধারী এস এম পারভেজ। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন। খুন, গোলাগুলি, চাঁদাবাজিসহ সমস্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দিনদিন নৃশংস হয়ে উঠেছে সুমন। ফ্ল্যাট দখল, জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায়, জুয়ার আসর পরিচালনা, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণসহ বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যখন তখন সশস্ত্র মহড়া কিংবা গুলি চালিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে সুমন। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অস্ত্র আইনে অন্তত ১৫টি মামলা আছে। এমনকি হাতকড়াসহ পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে।
২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে নগরীর কদমতলী এলাকায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় পরিবহন ব্যবসায়ী হারুনকে। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। শুভপুর বাসট্যান্ড ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় তাকে। এই হত্যার প্রধান আসামি মাদারবাড়ি এলাকার ত্রাস কিলার আলমগীর। পাঁচলাইশ এলাকায় জেলা পরিষদের এক সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে সেই আলমগীর কন্ট্রাক্ট কিলিং মিশনে কাজ করে। আলমগীর যুবলীগ নামধারী মোস্তফা টিপুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত এলাকায়।
গতবছর র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে খোরশেদ মারা যাওয়ার পর তার সাম্রাজ্যের হাল ধরেন টিপু। এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন, ফুটপাতের হকার, শিপিং অফিসে জাহাজের পরিত্যক্ত তেল সরবরাহ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, পিডিবি ও রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও ফুটপাত দখল নিয়ে সাবেক কাউন্সিলর শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের ও মোস্তফা কামাল টিপুর মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। এসব জায়গায় আধিপত্য ঠিকিয়ে রাখতে মরিয়া গ্রুপগুলো। আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাংয়ে মদদ দেওয়া ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
জনমনে ভয়ভীতি বাঁচিয়ে রাখতে খুন করতেও পিছপা হন না তারা। এমনই ভয়ংকর চিত্র বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এই জোনে। সদরঘাট থানা এলাকায় কর্ণফুলী নদী কেন্দ্রিক ঘাটের নিয়ন্ত্রণ, বন্দরের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ বাঁধে। তার চেয়েও ভয়াবহ চিত্র খুনের ঘটনায়। বছরের পর বছর এখানকার দুই গডফাদার খলিলুর রহমান নাহিদ ও জহির উদ্দিন বাবর গ্রুপ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার লড়াইয়ে বলি হয়েছেন অনেকে। বন্দর থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে পুলিশের খাতায় প্রথম নাম লেখান নাহিদ, মামলা নম্বর- ৩১(৬)৯৯। এরপর বিভিন্ন সময় একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হতে থাকেন। সেই সাথে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। ২০১৩ সালে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামি ছিলেন নাহিদ, সদরঘাট থানার মামলা নম্বর ৫(৮)১৩। একই বছর ১৬ আগস্ট আনিস নামে এক প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্রধানকে হত্যার জন্য হামলা চালান তিনি।
পুরো ঘর ঘেরাও করে গুলি বর্ষণ করে, পরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘরে ডুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে এবং গুলি করে নাহিদ নিজ হাতে। মৃত ভেবে সেখান থেকে চলে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে, এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা নাহিদকে প্রধান আসামি ও তার অন্যতম সহযোগী তোফায়েল আহমেদ রয়েল ও তার ভাই রাজন ওরফে রাজুসহ দশজনের নামে মামলা হয় সদরঘাট থানায়, মামলা নম্বর ১০(৮)১৩।
এদিকে, নালাপাড়া এলাকায় একটি হিন্দু পরিবারের বাড়ি দখলে নিয়ে আস্তানা গেড়েছেন অপর গ্রুপের গডফাদার জহির উদ্দিন বাবর। ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন সংগঠনের সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভেতরে চলে জুয়ার আসর, আছে মাদকের মিনিহাট! ব্যবসায়ী ও নিরীহ লোকজনকে এই ভবনে আটকে টাকা আদায়, টর্চার করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সন্ত্রাসী তালিকায় নগরে ১৯ নম্বরে নাম আছে বাবরের। অস্ত্র ও চাঁদাবাজি আইনে চারটি মামলার তথ্য আছে পুলিশ রেকর্ডে। কোতোয়ালি থানার আস্ত্র আইনে মামলা নম্বর- ৬(৫)৯৬, ডবলমুরিং থানার মামলা নম্বর যথাক্রমে- ২৮(২)০২, ৬৫(৭)৯৮, ৬১(৮)৯৮। এছাড়া আরো বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খলিলুর রহমান নাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আগে মামলা ছিল। এসব মামলা বিএনপি সরকারের আমলে দায়ের হওয়া। কিশোরগ্যাংয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
সাবেক কাউন্সিলর মো. আবদুল কাদের বাংলানিউজকে বলেন, আমি রাজনীতি করি। রাজনীতি করলে প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে এসবের কোনো ভিত্তি নেই। আমার বিরুদ্ধে এক সময় অনেক মামলা ছিল। এসব মামলা গত নির্বাচনের পরে সব নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি, কিশোরগ্যাং যেসব বিষয় বলা হচ্ছে এসব ভিত্তিহীন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোস্তফা কামাল টিপুকে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। জহির উদ্দিন বাবর ও এসএম পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, সন্ত্রাসীদের গডফাদার ও কিশোরগ্যাংয়ের ‘বড় ভাই’ যারা রয়েছে তাদের আমরা নজরদারিতে রেখেছি। প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। প্রভাব বিস্তার করে চাঁদাবাজি, দখলবাজি যারা করে আসছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।