গবেষক কে? গবেষণা কি? বিজ্ঞানী কে? বিজ্ঞানী কি গবেষক? গবেষণার কি শাস্ত্রীয় পদ্ধতি আছে? শাস্ত্রীয় পদ্ধতি ছাড়া গবেষণা হয় না? এতোগুলো প্রশ্নের অবতারণা সাধারণের কাছে বেখাপ্পা মনে হলেও অসাধারণের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
গবেষণা, গবেষক, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর পারস্পরিক সম্পর্ক জানা না থাকলে কোন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোন সিদ্ধাতেই পৌঁছুনো যায় না। এ কারণে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্ধারণে শাস্ত্রীয় আলোচনার দরকার সবার আগে। পরে ব্যক্তিকে সামাজিক সম্পর্কের ভেতরে অস্তিত্বমান করে সামাজিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যায় বা নির্দেশনায় তাঁর কৃতিত্ব দেখতে হবে। বিজ্ঞান ও গবেষণা মুদ্রার দু’পিঠ। দু’পিঠের সম্মিলনেই মুদ্রার অস্তিত্ব। দুটোকেই সংজ্ঞায়িত করবার আগে প্রয়োজন এটা জানা যে, গবেষণা আগে না বিজ্ঞান আগে। এর যুথসই উত্তর দেয়া বেশ কষ্টকর। সমাজ আর অর্থনীতির পরিবর্তনের কারণ বিজ্ঞান, আর বিজ্ঞানের অস্তিত্ব গবেষণায়। তবে গবেষণা বিজ্ঞানের অস্তিত্বের ধারণার উপর নির্ভরশীল।
বিজ্ঞান কী? আমাদের চারপাশের জগৎটা একটা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। এই নিয়মের অধীনেই প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে। গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে। ফলের মাটিতে পড়া একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এর কারণ হলো মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তি। কারণ ও কার্যের সম্পর্ক নির্ধারণ করলেই তা’ হবে বিজ্ঞান। সামাজিক ঘটনাবলীও কতগুলো নিয়মের অধীন। সামাজিক বিজ্ঞান, ঘটনাবলীর সামাজিক বা প্রাকৃতিক কারণগুলোর সাথে ঘটনার সম্পর্ক নির্ণয় করে। যে বিষয় উল্লেখ করা হলো যে, গাছের ফল মাটিতে পড়া এবং মাধ্যাকর্ষণের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয় করা বিজ্ঞানের তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠার শর্ত তা কি গবেষণালব্ধ? বিজ্ঞানী নিউটন ফল মাটিতে পড়া পর্যবেক্ষণ করেছেন দীর্ঘকাল। পর্যবেক্ষণ আজকের শাস্ত্রীয় গবেষণায় একটি পদ্ধতি। নিউটন এ পদ্ধতির আদিঅন্ত শাস্ত্রীয়ভাবে না জেনেই প্রায়োগিক দিকটা ব্যবহার করেছেন খুব ভালোভাবেই। ভাষা আগে না ব্যাকরণ আগে? ভাষা থাকলেই তাকে নিয়মের অধীন করা যায়। কার্যকারণ সম্পর্কের হাজারো উদ্ঘাটনের ফলেই পদ্ধতিসমূহের উদ্ভাবন হয়। টমাস এডিসনের আবিষ্কারগুলো কোন শাস্ত্রীয় পদ্ধতি চর্চার ফল নয়। তবে এ আবিষ্কারগুলোর প্রক্রিয়াকে নিয়মবদ্ধ করতে গিয়েই পদ্ধতিসমূহের উদ্ভব হয়। পদ্ধতি তাই অন্তহীন। নয়া আবিষ্কারের সাথে পদ্ধতির উদ্ভব ঘটছে এখনও।
গবেষণা কি? কোন ঘটনার কারণগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে বের করা এবং কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ বা বিজ্ঞানের তত্ত্বের আবিষ্কার করা। ব্যাকরণের অস্তিত্বের উপর ভাষার অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়, ঠিক তেমনি শাস্ত্রীয় গবেষণার উপরও গবেষণা ও বিজ্ঞানের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়। যদি তা হতো তাহলে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এডিসন, নিউটন, মার্কস বা অগাস্ট কোঁৎ কাউকেই বিজ্ঞানী বলে উল্লেখ করা যেতো না। বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় গবেষণা পদ্ধতির চর্চা গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে শুরু। হাজার বছরের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ফলে লব্ধ প্রক্রিয়াগুলো শাস্ত্রবদ্ধ করলেন কিছু সমাজ সূত্রকাররা, আর তাই-ই কালে গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হলো। এই মুহূর্তে সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতি একটি প্রচলিত গবেষণার মুখ্য বিষয় হলে ধ্রুপদী সমাজতত্ত্বে এর উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে।
ফরমায়েশি সার্ভে বা এনজিওদের গবেষণায় শাস্ত্রীয় গবেষণাপদ্ধতির বিষয়টি উঠে আসে প্রথমে। বিজ্ঞান ও গবেষণা মৌলিক আবিষ্কার ও অনুসন্ধানগুলো বলতে গেলে আজকের শাস্ত্রীয় গবেষণা পদ্ধতিকে উপায় হিসেবে বিবেচনা করে হয়নি বরঞ্চ স্বতঃস্ফূর্ত মানব আচরণের অনুসন্ধানী আকাঙ্ক্ষা প্রক্রিয়া খুঁজে নিতে সাহায্য করে। উপরে এতসব কথা উল্লেখ করবার একটি কারণ হলো বাংলাদেশের সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের সাহিত্যে গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চাকে একেবারেই শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। অনেকেই একথা ভাবতে চাইছেন না যে, কর্মজীবী হওয়ার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দরকার হলেও বিজ্ঞানী বা গবেষক হওয়ার জন্যে তার দরকার নেই। এদের অনেকেই গবেষক হওয়ার জন্য গবেষণার ব্যাকরণ বিশারদ হলেও সমাজতত্ত্বে বা সামাজিকবিজ্ঞানে এক রত্তি জ্ঞানও যোগ করতে পারেননি। এঁদের কাছ থেকেই আমাদের দেশে সামাজিকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গবেষকরা। শাস্ত্রীয় গবেষণার কথা বলে নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে চাইছেন। এদের স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অনেক গবেষক ও গবেষণাকর্মকে যথাযথ মূল্যায়নের পথে প্রতিবন্ধক হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য নৃতত্ত্ব গবেষণায় বাংলাদশে পথিকৃৎদের একজন হচ্ছেন আবদুল হক চৌধুরী। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির মুখোশ এঁটে থাকায় সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বে তাঁর অসামান্য অবদান আমাদের দৃষ্টির আড়ালে ছিলো। তবে সমাজতত্ত্ব বা নৃতত্ত্বের উদ্ভবের গোড়ায় গেলে আবদুল হক চৌধুরীর অবদান দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে।
কবি কে? এ প্রশ্নের উত্তর হলো যিনি কবিতা লেখেন। ইতিহাসবিদ কে? যিনি ইতিহাসের ঘটনাবলিকে কালানুযায়ী বর্ণনা করেন। আর যিনি এসব উপাদানকে সংগ্রহ করেন এবং কার্যকারণ সম্পর্কের আওতায় এনে সূত্রবদ্ধ করেন তিনি তখন বিজ্ঞানচর্চাই করেন। বর্ণনামূলক ইতিহাস বিজ্ঞান নয়। কেননা এ শুধু ঘটনার বর্ণনাই দেয়, ঘটনা ঘটবার পেছনের কারণসমূহকে উদ্ঘাটন করেন না। কারণসমূহ উদ্ঘাটিত হলে তা সামাজিক ইতিহাস হয়ে ওঠে। গবেষণার এই প্রাথমিক দায়িত্বটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সামাজিক-কাঠামোর ব্যাখ্যায় চমকপ্রদভাবে আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণায় উঠে এসেছে। মানুষের জন্ম ও বৃদ্ধি যে পরিবেশ ও সামাজিক শৃঙ্খলার ভেতর গড়ে ওঠে তা গবেষকের মানস গঠনে ভূমিকা রাখে।
ভারত উপমহাদেশের প্রান্তীয় অঞ্চল যার বৈশিষ্ট্য উত্তর-পশ্চিম ভারত উপমহাদেশ থেকে একেবারেই পৃথক সেরকম এক জনপদ, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন নোয়াজিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর ৭২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব একটা বেশি অর্জন না করলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিদদের জন্য মূল্যবান গবেষণাকর্ম রেখে যেতে পেরেছেন। গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর পিতা আলহাজ্ব সরফুদ্দীন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন রেঙ্গুন পোর্ট কমিশনের ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ১৯৩০ সনে নিজ গ্রামে “নোয়াজিশপুর” প্রাথমিক বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। মাতা মোমেনা খাতুন চৌধুরী রাউজান থানার ডাবুয়া গ্রামের জমিদার দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীর তৃতীয় অধঃনস্ত পুরুষ আলহাজ্ব ইসমাইল চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। এ পারিবারিক ঐতিহ্য বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ আবদুল হক চৌধুরীকে যে শিক্ষানুরাগী করে তোলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবদুল হক চৌধুরী শুধুমাত্র গবেষক, সমাজবিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি সামাজিক দায়িত্ব পালনেও সম্মুখ ভাগেই ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত হন। পারিবারিক পরিবেশ ও ঐতিহ্য গবেষক আবদুল হক চৌধুরীকে ১৯৪৪ সালে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ-এর সান্নিধ্যে নিয়ে আসে এবং সাহিত্যবিশারদের মোটিভেশনেই তিনি সম্ভবত প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় উপাত্ত সংগ্রহে সচেষ্ট হন। তাঁর দীর্ঘকালের ঐকান্তিক চেষ্টা ও নিষ্ঠার ফলে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “চট্টগ্রাম ইতিহাস প্রসঙ্গ” প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থতালিকায় “চট্টগ্রাম ইতিহাস প্রসঙ্গ”, “চট্টগ্রামের চরিতাবিধান”, “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি”, “সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ”, “শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা”, “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা”, “চট্টগ্রাম আরকান”, “চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ”, “প্রাচীন আরকান, রোহিঙ্গা, হিন্দু ও বড়ুয়া, বৌদ্ধ অধিবাসী”, “বন্দর শহর চট্টগ্রাম”, “প্রবন্ধ বিচিত্রা”, “ইতিহাস ও সাহিত্য” ইত্যাদি সংযোজিত হয়। উপরিল্লিখিত বিষয়ে লিখিত রচনাগুলোর সবগুলোই গবেষণা পদ্ধতির সমস্ত শাস্ত্রীয় রীতি অনুসরণ করেই রচিত। তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা করা এবং তথ্যের ভেরিফিকেশন সমস্ত কিছুই প্রক্রিয়াজাত করেই শুধুমাত্র তথ্যের ব্যবহার তিনি করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো পুরোপুরি সমাজতাত্ত্বিক। তাঁর “শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা” কিংবা “বন্দর শহর চট্টগ্রাম” বইতে প্রাচ্যের সমাজে বন্দর গড়ে ওঠবার প্রাকৃতিক ও সামাজিক কারণগুলো বর্ণিত আছে। প্রাচ্যে শহর হচ্ছে প্রশাসন, তীর্থস্থান ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উত্থিত। চট্টগ্রাম বাণিজ্য ও তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত। আবদুল হক চৌধুরীর দৃষ্টি থেকে শহর গড়ে ওঠবার এই সামাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি চমকপ্রদভাবে উঠে এসেছে। আর তা ছাড়া টৎনধহরংস বা শহর-সংস্কৃতির ব্যাখ্যা বাংলা ভাষায় সম্ভবত খুব কমই লেখা হয়েছে। আবদুল হক চৌধুরীর লেখাতে টৎনধহব ও টৎনধহরংস ও উঠে এসেছে যা পুরোমাত্রায় সমাজতাত্ত্বিক।
সমাজতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বিষয়টা বিশাল। কোন সমাজ আর অর্থনীতির একটা ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক আওতা থাকে। একটা নির্দিষ্ট সমাজের একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকে। ভৌগোলিকভাবে যতই দূরবর্তী হতে থাক সেই সাংস্কৃতিক মন্ডলের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী সংস্কৃতি ও সমাজের প্রভাবটা ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যদি আরব হয় তবে, এর দূরবর্তী অঞ্চলের (যেমন ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপিন্স) সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে ভিন্নমাত্রার হয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রভাবেই এমন হয়ে থাকে। কোন জাতি-গোষ্ঠীরই অবিমিশ্র সংস্কৃতি নেই। চট্টগ্রাম ভৌগোলিকভাবে নৃতাত্ত্বিক ও নৃগোষ্ঠীর বিবেচনার একটি সন্ধি অঞ্চল। বাঙালির মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যের যা কিছু বর্তমান তা এই অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাসের ফল। আবদুল হক চৌধুরীর “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ” কিংবা “চট্টগ্রাম আরকান” গ্রন্থসমূহে নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে যাতে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে ওঠবার বিষয়টি বিধৃত আছে। সম্ভবত বাংলাদেশের কোন নৃবিজ্ঞানীই এ বিষয়টি এমনভাবে আলোচনা করেন নি।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে সিলেটও একটি প্রান্তীয় অঞ্চল যার বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে সামান্য ভিন্ন। আবদুল হক চৌধুরীর প্রান্তীয় সংস্কৃতির চর্চার অনুসন্ধানী মন সিলেট অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গঠনের বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। সমাজতাত্ত্বিক হওয়ার জন্য সমাজতত্ত্বে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান শুধুমাত্র নয় বরং সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণটা আয়ত্ত করা দরকার। আবদুল হক চৌধুরী অনেক প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতত্ত্ব পড়ুয়াদের চেয়েও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণটা রপ্ত করেছেন ভালোভাবেই। তাঁর গবেষণাকর্মের প্রতিটি প্রতিবেদনে এটা একেবারেই পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেকোনো ঘটনার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ খুঁজে ঘটনার সাথে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করাই সমাজতত্ত্বের কাজ। এর জন্যে আগেই বলেছি প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতাত্ত্বিক হওয়ার দরকার নেই। ইবনে খালদুন, আগস্ট কোঁৎ বা কাল মার্কসও প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতাত্ত্বিক ছিলেন না। তবে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করবার কারণে এরা প্রখ্যাত হয়েছেন। আমাদের এখানেও বিনয় কুমার সরকার কিংবা আবদুল হক চৌধুরীকে এ পর্যায়ে ফেলতে পারি। গবেষণা ও বিজ্ঞানের যে প্রাথমিক দায়িত্ব সেটা আবদুল হক চৌধুরী একেবারেই নিখুঁতভাবে পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, যে মাটির সন্তান তিনি তার প্রতিও দায়িত্ব পাল করেছেন যথাযথভাবে।
চট্টগ্রামের মাটিতে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের জন্ম হলেও চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, সমাজ ও সমাজ-কাঠামোর এমনতরো বিশ্লেষণ খুব একটা নজরে পড়ে না। এই দিকটি সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগ প্রথমেই নজরে আনে এবং “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ” গবেষণাধর্মী বইটি রিভিউসূচিতে ও পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে রিসোর্সের যথাযথ উন্নয়নে যে ভূমিকা থাকে আমাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মানসিক রিসোর্সেরও সে ভূমিকা থাকে। আবদুল হক চৌধুরী নামের যে রিসোর্স এখনও অব্যবহৃত আছে তা এক্ষুণি ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। কেননা একথা মানতে হবে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে যা প্রচ্ছন্নভাবে আবদুল হক চৌধুরীও বলে গেছেন তাঁর গ্রন্থগুলোতে। লেখক : প্রফেসর, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।