তবে কি তীরে এসে তরী ডুবতে বসেছে ট্রাম্পের? যদি ট্রাম্প এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে তার আখেরী ‘ট্রাম্প’ কার্ডটি ঠিকমত চালতে না পারেন তাহলে বাজিমাৎ যে করবেন তার বর্ণনায় ‘স্লিপি’ বা ‘ঘুমন্ত’ বাইডেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নির্বাচনী লড়াই শুরুর আগ থেকে ট্রাম্প, তার সমর্থক, রিপাবলিকান দলের বাঘা বাঘা নেতারা ধরে নিয়েছিলেন যে তাদের প্রার্থী, হোক না তিনি কথাবার্তায়, চিন্তা-চেতনায় কিংবা কাজকর্মে ‘উদ্ভট’ প্রকৃতির, বিজয়ের ‘মুকুট’ ছিনিয়ে আনবেন দলের জন্যে। রিপাবলিকান পার্টিকে জয়ী করে আরো চার বছরের জন্যে হোয়াইট হাউস তাদের দখলে রাখতে সফল হবেন তারা। সে কারণে এদ্দিন তারা মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। পছন্দ না হলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলে কিছু বলেননি, সমালোচনা করেননি ট্রাম্পের কোন কাজকর্মের, কথাবার্তার। তারা জানেন ট্রাম্পের একটি ‘ডেডিকেইটেড’ ভোট ব্যাংক রয়েছে, যা কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনের একেবারে দোরগোড়ায় এসে খোদ ট্রাম্প সহ রিপাবলিকান দলের নেতা, সিনেটরদের অনেকেই বুঝি একটু হোঁচট খেতে শুরু করেছেন। আর সে কারণে নির্বাচনের মাত্র ১০/১২ দিনের মাথায় এসে তাদের কেউ কেউ ট্রাম্পের কাছ থেকে তাদের অবস্থান যে দূরে, সেটি খোলাসা করে বলতে শুরু করলেন। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ বলে প্রবাদ আছে। কেননা এখন তারা ট্রাম্পের জন্যে নয়, তারা শংকিত নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের আসন রক্ষা করতে পারবেন কিনা সেটি ভেবে। গেল প্রায় চার বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হেন কর্ম করেননি যা দলকে, দলের নেতাদের এমন কী দলীয় সমর্থকদের নানা সময়ে নানাভাবে বিব্রত করেছে। ট্রাম্পের ‘আন-প্রেসিডেনশিয়াল’ কথাবার্তা, আচরণ, যা এ যাবত কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট করেননি, তার অনেক কাছের নেতাদের, পরামর্শকদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। সমপ্রতি তাদের অনেকেই তার কাছ থেকে সরে এসেছেন, তাদের সমর্থন সরিয়ে নিয়েছেন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে। খোদ হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন চীফ অফ স্টাফ, অবসরপ্রাপ্ত মেরিন জেনারেল জন কেলি তার নিকট বন্ধুদের ট্রাম্প সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন সব চাইতে ত্রুটিপূর্ণ একজন ব্যক্তি’, যা তিনি তার গোটা জীবনে আর দেখেননি। তাতেই থেমে থাকেননি ট্রাম্পের এক সময়কার খুব কাছের এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, ‘তার অসততার গভীরতা অবাক করার মত’। কেবল জেনারেল কেলি নন। এতদিন পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ট্রাম্পের এক সময়কার অনেক উপদেষ্টা, কর্মকর্তা ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ। ‘দি ইনসাইডার : এ ওয়ার্নিং ফ্রম ট্রাম্প অফিস’ শীর্ষক সিএনএনের বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জন বোল্টন, প্রাক্তন হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসেস বিজ্ঞানী রিক ব্রাইট এবং প্রাক্তন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জেনারেল কনসাল জন মিটনিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কেন এই অফিসের জন্যে ‘আনফিট’ বা অনুপুযুক্ত সেই যুক্তি তুলে ধরেন। গেল সপ্তাহে প্রাক্তন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ৪৩ সহকারী ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের বিশ্বস্ত আইন উপদেষ্টা নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়র রুডি জুলিয়ানির মেয়ে জো বাইডেন ও কমলা হেরিসকে ভোট দেবার জন্যে আমেরিকানদের প্রতি আহবান জানান। কেবল তাই নয়, ৩১ বছরের এই কন্যা তার বাবাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত বুলডগ’ বলে অভিহিত করেন।
নিজেকে অতি স্মার্ট ও চালাক ভাবা ট্রাম্প সব কিছু মনে হয় লেজে গোবরে করে ফেলেছেন। চমক দেখানো তার কাজ। কিন্তু তার অতি চমকবাজি বা স্ট্যান্ডবাজি অনেক ক্ষেত্রে ‘বুমেরাং’ হয়ে তাকে আঘাত করতে শুরু করেছে। শুরু থেকে নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার জন্যে দায়ী তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সততার অভাব। তিনি অর্থলোভী, ঠকবাজ এমন অভিযোগও তার সম্পর্কে রয়েছে। তার যে গোয়ার্তুমি স্বভাব, উল্টোচলা স্বভাব সে তা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয় বিশ্বের কোন দেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধানের এতগুলি দোষ জনগণের সামনে প্রকট হয়ে কখনো ধরা পড়েছে বলে জানা নেই। গোটা দেশ যে দিকে চলেছে তার উল্টো দিকে যেন তাকে চলতেই হবে। তিনি যা ভাল মনে করেন সেটিই সত্য এবং সেটি করেই ছাড়বেন, গায়ের জোরে, ক্ষমতার জোরে এবং তাই করে এসেছেন এতদিন। আমেরিকার জাতশত্রু রাশিয়ার সাথে তিনি কোন এক রহস্যজনক ও অজ্ঞাত কারণে হাত মিলিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। পুতিনের কাছে তিনি নত থেকেছেন কোন জাদুর বলে সে একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন, যদিও বা এ নিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এবং পত্র-পত্রিকায় নানা কাহিনী রয়েছে। তিনি ক্ষমতায় এসেই আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বিষয়টিকে অস্বীকার করে বললেন, এসব ‘হোঙ’। ইউনেস্কো থেকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিলেন। আমেরিকার জনগণের স্বাস্থ্য-সেবার জন্যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রবর্তিত ‘ওবামা কেয়ার’ থেকে তিনি সরে এলেন। ন্যাটো নিয়ে নাটক করলেন। ইউরোপকে বৈরী করে তুললেন। মোট কথা বিশ্বে আমেরিকার সত্যিকার অর্থে মিত্র আর রইলোনা। বিশ্বের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল আমেরিকার স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন তিনি। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে আমেরিকার সেনাবাহিনীকে হয় ঘরে ফিরিয়ে আনলেন নয় তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিলেন। সব শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে উঠিয়ে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ, দাবি করলেন সংস্থা প্রধানকে চাকরিচ্যুত করার, কেননা তার ভাষায় তিনি (সংস্থা প্রধান) করোনা ইস্যুতে চীনের হয়ে কাজ করেছেন এবং চীনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। আর সে কারণে তৎক্ষণাৎ বন্ধ করলেন সংস্থাটির প্রতি এতদিন ধরে দিয়ে আসা সমস্ত আর্থিক সহায়তা। ট্রাম্পের বিগত প্রায় চার বছরের অনেক ব্যর্থতার মধ্যে ‘করোনা’ মোকাবেলায় তার চরম ব্যর্থতার জন্যে হয়তো আর সপ্তাহ পর তাকে তার চরম রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে, যদি শেষ মুহূর্তে কোন ‘চমক’ না ঘটে। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোন কথা নেই। যখন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাবিদরা ও বিজ্ঞানীরা, এমন কি সেরা চিকিৎসাবিদ ড. ফাউচি ‘মাস্ক’ পরার জন্যে পরামর্শ দিচ্ছেন তখন তিনি এটি নিয়ে হাসি-তামাশা করেছেন এবং এখনো করছেন। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ প্রদর্শন না করে ‘মাস্ককে’ ঘিরে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনকে নিয়ে ‘মশকরা’ ও ‘কৌতুক’ করেছেন। এতে তার সমর্থকরা মজা পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠী, এমন কী অনেক রিপাবলিকান দলীয় নেতা ও সমর্থক তার এই ধরনের আচরণ ও মন্তব্য পছন্দ করেননি।
তবে এমন না যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবকিছু মন্দ। বিশেষ করে তার সমর্থকদের দৃষ্টিতে তিনি কিছু ভালো কাজও করেছেন। আমেরিকায় ইসরায়েল বা ইহুদী-লবি বড় শক্তিশালী। আমেরিকার রাজনীতিতে এই লবির বিশাল ভূমিকা রয়েছে, আর্থিকভাবে এবং ভোটের কারণে। প্রধানমন্ত্রী বেনজামিনের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণাকে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য ও প্যালেস্টাইনী জনগণের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পূর্ণ সমথর্ন প্রদান করেন এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরিত করেন। ইসরায়েলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনও অনেকে তার সময়ে কূটনৈতিক সফলতা হিসাবে দেখছেন। সমালোচনা হলেও ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে তাদের বাৎসরিক আর্থিক অনুদান বাড়াতে তিনি বাধ্য করেছেন। তবে তার নিন্দুকেরা বলেন, কাজটি সুন্দর ও সম্মানজনকভাবে করা যেত। অভিবাসন ইস্যু নিয়ে তার গৃহীত পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীর অনুপ্রবেশ যে অনেকটা কমেছে সেটি কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না। আমেরিকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী যে বিদেশী অনুপ্রবেশ যা ট্রাম্পের ভাষায় ‘সুনামি’ ঠেকানোর পক্ষে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন না যে তার পূর্বতম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইমিগ্রেন্টসদের জন্যে অনেক কিছু করেছেন। তার (ওবামা) সময়েও প্রচুর সংখ্যক ‘ডকুমেন্টবিহীন’ অভিবাসীকে জোর করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ট্রাম্পের বড় দোষ প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে তিনি কথা বলেন এবং বিতর্কিত হন। সমালোচিত হলে সাথে সাথে উল্টে যান, অস্বীকার করেন পুরো ব্যাপার। ফলে আরো বেশি সমালোচিত হন। তিনি ‘ব্ল্যাক লাইভস মেটার’ আন্দোলন দমানোর জন্যে ফেডারেল মিলিটারী পাঠান। আন্দোলনকারীদের তিনি লুঠেরা, ক্রিমিন্যাল, ধর্ষক বলে আখ্যায়িত করেন। এমন না যে তার আগে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালোরা’ ভালো ছিল। তেমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। মূলতঃ আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের (১৮৬১-৬৫) পর খুব কম প্রেসিডেন্টই, এমন কী বারাক ওবামা, যিনি নিজেও কৃষ্ণাজ্ঞ, কালোদের মঙ্গলের জন্যে, তাদের ক্ষমতায়নের জন্যে কাজ করেছেন। প্রেসিডেন্ট লিংকন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বাতিল করেন। এবারের নির্বাচনে যদি ট্রাম্পের ভরাডুবি হয় সেটি হবে তার কিছু পদক্ষেপ যা উপরে উল্লেখ করেছি এবং কিছু ইস্যুতে তার দেয়া অসংযত ও অগ্রহণীয় বক্তব্যের জন্যে। এর অন্যতম হলো, ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসীর’ পক্ষে তার দাঁড়ানো এবং একে নিন্দা জানানো থেকে বিরত থাকা। করোনা মোকাবেলায় তার সম্পূর্ণ ব্যর্থতা অন্যতম প্রধান কারণ। এই নির্বাচন ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দলের লড়াই নয়, এ লড়াই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে আমেরিকার গণতন্ত্রের লড়াই। দেখা যাক এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে কে জেতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট