: সৎ ও পরিশ্রমী একজন মানুষের গল্প।
: সে মানুষটি আবুল মিয়া। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এর বন্ধু। তিনি বলতেন আবুল মিয়া দুর্লভ চরিত্রের মানুষ। গরীব ঘরের ছেলে। ন্যায়পরায়ণ এবং পরিশ্রমের ফলে তিনি শূন্য থেকে শীর্ষে ওঠতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো এই ভাবে,
১. বেতন ছাড়া পেটে ভাতে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ দিয়ে। বিনিময়ে একবছর পর পেয়েছিলেন ১০ পয়সা মূল্যের একটি গেঞ্জি এবং ১৪ পয়সা মূল্যের একখানা লুঙ্গি।
২. একটু বয়স বাড়লে ৮ আনা বেতনের চাকরি গ্রহণ করেন, কাজ ছিলো গৃহস্থালী, চাষাবাদ। সাথে দু’বেলা খাওয়া। সেই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত।
কোনোদিন পড়ালেখা শেখার জন্য স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তবে একবার পড়ার ইচ্ছা নিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু সেই একবারই। তারপর ভবঘুরে জীবন। মা ছিলেন তাই সুপথ পেয়েছিলেন। ভিক্ষা করেননি তবে ভিক্ষা গ্রহণের উপযোগী ছিলেন। এমন একজন মানুষ মহান আল্লাহর সহায়তায়, নিজের সততা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা ঘুরাতে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং নিজের জন্য সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তুলেছিলেন।
: কেমন করে তা সম্ভব হয়েছিলো?
: পেটে ভাতের দিন মজুর, কৃষি শ্রমিক এই আবুল মিয়া মা ও বড় ভাইকে দু’মুঠু ভাতের সন্ধান দেওয়ার জন্য নিজের সততাকে পুঁজি করে ৮ আনা বেতনের চাকরি ছাড়লেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। দেখেন অনেক মিলিটারি। তারা আবুল মিয়াকে কুলি মনে করলেন। তাকে তাদের মালামাল বহনের জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি কাজ করে দিলেন বিনিময়ে পেলেন ৬ টাকা। জীবনে একসাথে এতো টাকা তিনি দেখেননি। তখন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। একদিন জুম্মার দিন। তিনি যাচ্ছিলেন পতেঙ্গায় মালিকের খাবার নিয়ে। ফেরার পথে দেখেন জাপানি বোমা পড়ছে। তিনি ঝাঁপিয়ে পুকুরে পড়েন। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। পরদিন তার বাড়ি উত্তর হালিশহর মইন্ন্যা পাড়ায় দেখেন কিছু আহত সৈন্য আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙা ঘরে তাদের দেখে মায়া হলো। তারা সামরিক পোশাক ছেড়ে কিছু কাপড় চাইলেন। তখন আবুল মিয়া পুরানো কাপড়, কাঁথা তাদের দেন, তারা খুব খুশী হন। সৈন্যরা তাকে জোর করে ২০ টাকা দেয়। এতো টাকা পেয়ে তিনি বিহবল হয়ে পড়েন। পরদিন চাকরি দাতাকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। মালিক পুরো ঘটনা জেনে তাকে চাকরি থেকে মুক্তি দেন এবং পরামর্শ দেন ব্যবসা করার জন্য।
এইতো ব্যবসার শুরু। আর্মি ক্যাম্পের সামনে কমলালেবুর ব্যবসা, গাছতলায়। মানুষের বিশ্বাস জন্ম নেয়, প্রমাণ মেলে সততার। ব্যবসার ধরণ বদলাতে শুরু করে। কখনো লাভ, কখনো লোকসান। আস্তে আস্তে শহরে খুঁজে নিলেন ব্যবসার স্থান। স্টেট ব্যাংকের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) সামনে শরবতের দোকান, ঘর ভাড়া নিলেন। ভালো মানুষদের সাথে সখ্য সম্পর্ক হলো, আয় বাড়লো, বড় ভাই দোকানে সহযোগী হলেন। ভাগ্যের চাকা খুলে গেলো। ১৯৬১ তে চীন দেশের টায়ার আনার প্রস্তাব পেলেন। নিযুক্ত হলেন চিনা টায়ারের সোল এজেন্ট। চীন গেলেন, পেলেন বড় মাপের সংবর্ধনা। বিক্রি বেড়ে গেলো। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ (৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর) শুরু হলো। অন্যান্য দেশের টায়ার আসা বন্ধ হলো। আবুল এন্ড কোম্পানির টায়ারের চাহিদা বাড়লো, সেনাবাহিনী এবং চট্টগ্রাম বন্দর একচেটিয়া ক্রেতা। টায়ারের দাম না বাড়িয়ে তিনি সততার পরিচয় দিলেন। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধ পুরো পাকিস্তানের টায়ার টিউব ব্যবসায়ী মহলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। চীনা কর্তৃপক্ষ খুব খুশী হলেন এবং তিনি পেয়ে গেলেন সম্মান ও মর্যাদার এক বড় আসন। প্রতিষ্ঠা করলেন দেশে ৩৫টি শো-রুম। অনেক সাধারণ মানুষকে তিনি ব্যবসায়ী বানালেন। প্রচুর মানুষের কর্মের সংস্থান করলেন।
: কেন তিনি এতোটা সফলতা পেয়েছিলেন?
১. চরম ধৈর্য এবং শুধুই ধৈর্য, ক্ষুদ্র পুঁজির মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।
২. বিভ্রান্তির মধ্যে পড়লেও হতাশ হননি, নিজের প্রতিবিশ্বাস হারাননি।
৩. দুঃখকে জয় করেছেন প্রচন্ড মনোবল দিয়ে।
৪. মিথ্যাকে সত্যের সাথে মিশিয়ে আপোষ করেননি।
৫. ব্যবসাকে শতভাগ হালাল বিবেচনা করেছেন।
৬. অর্থের উত্থানে রোমাঞ্চিত হয়ে বিপথে যাননি।
৭. উপকারির উপকার স্বীকারে কৃপণতা প্রদর্শন করেননি।
৮ অন্যের হক খেলাপ করেননি, পাওনাদারদের ঋণ পরিশোধ করেছেন সম্মানের সাথে।
৯. ছোট বড় ব্যবসার ক্ষেত্রকেই পবিত্রতা দিয়ে মূল্যায়ন করেছেন।
১০. ব্যবসার ক্ষেত্রে কথার বরখেলাপ করেননি।
এসব কারণে তিনি কৃষি শ্রমিক, কাঁচামাল ব্যবসায়ী, কমলালেবুর দোকানি, ব্রোকারি, পান শরবতের দোকানি, শরবত বিক্রেতা থেকে মোটর টায়ার টিউবের এজেন্ট হয়েছিলেন। একেবারে ফকির থেকে আমির। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন সত্য কিন্তু সাধারণ জীবনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের অতি সাধারণ মানুষদের নিয়ে থাকতেন, চলতেন। কারণ তিনি তাঁর অতীত ভুলেননি, ভুলতে চাননি। টাকা দিয়ে তিনি মানুষকে মূল্যায়ন করেননি। ধর্ম, বর্ণ, অর্থ মানুষের মূল্যায়নের বিষয় ছিলো না। বিষয় ছিলো প্রকৃত মানুষ কারা। তবে মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ ইসলামি ভাবাদর্শের। এজন্য তাঁর মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদী সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ লিখেছিলেন, আলহাজ্ব আবুল মিয়া, এক দুর্লভ চরিত্রের মানুষ। শ্রম, নিষ্ঠা ও সততার উপর নির্ভর করে তিনি চরম দারিদ্র্য থেকে বিত্তবান হয়ে উঠেছিলেন। পন্ডিত ছিলেন না, ক্ষমতার বাঘের পিঠে উঠার তার লিপ্সা ছিলো না। নিজ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি সমাজ সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। দারিদ্র্য তাঁকে বেদনা দিয়েছে, যন্ত্রণা দিয়েছে কিন্তু লোভাতুর করেনি। তাই বিত্ত তাঁর চিত্তকে লোভাতুর করেনি। নিষ্পেষিত করতে পারেনি। তিনি পাড়া প্রতিবেশী এবং মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। এই ভালোবাসা ছিলো নিঃস্বার্থ, শর্তহীন। দারিদ্র্যের বেদনা, যন্ত্রণা প্রসূত অনুভব। উপলব্ধি থেকে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে। মানবসেবাকে তিনি এবাদত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। লোভ তিনি দমন করেছিলেন, ৫৫টি মানবিক প্রতিষ্ঠান ছিলো তাঁর প্রাণের সম্পদ। তিনি তাঁর পুত্র, কন্যা, জামাতা, পুত্রবধূদের সেবার কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের সাথে থেকেই তিনি জীবনের পর্ব শেষ করেছিলেন। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এবং তার স্ত্রী অবদান বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সাথে সম্মান জানিয়েছিলেন। ১৯৭১-১ মার্চ থেকে তাঁর বাড়িটি ছিলো সেবা ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, ই পি আর সৈন্যদের প্রথম প্রতিরোধ ও যুদ্ধ কেন্দ্র, পাকিস্তানীরা বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। তাঁকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধায়। সবদল ও মতের সম্মান পাওয়া এই মানুষটি লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসার উর্ধ্বে ছিলেন। তাই তিনি আজো সর্বমহলে শ্রদ্ধার মানুষ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।