ইলিশের খাদ্য তালিকার ৯৭ থেকে ৯৮ ভাগ হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন বা উদ্ভিদকণা। এর উপস্থিতি বেশি রয়েছে বঙ্গোপসাগরের মেঘনা নদীর অববাহিকায়। ফলে খাবারের টানে মেঘনায় ইলিশের আনাগোনা হয় বেশি। আবার ইলিশের পোনা বা জাটকা খাদ্য হিসেবে পছন্দ করে জুপ্লাংটন বা প্রাণিকণা। এটাও সর্বোচ্চ পাওয়া যায় মেঘনা অববাহিকায়। ফলে মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী ও উপকূলবর্তী অগভীর অঞ্চলে জাটকা বিচরণ করে এবং বেড়ে ওঠে। অর্থাৎ দুটো তথ্য বলছে, মেঘনাতেই ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চারজন শিক্ষকের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। গবেষণায় ইলিশের সর্বনিম্ন উৎপাদনশীল এলাকা হিসেবে গভীর সমুদ্র বা দূর সমুদ্রকে চিহ্নিত করা হয়। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কানেক্টস হিলশা ফিশারিজ ইন বে অব বেঙ্গল’ শিরোনামে গবেষণার পূর্ণ প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে গবেষকবৃন্দ বঙ্গোপসাগরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতার সাথে ইলিশের প্রাচুর্যের সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক ড. মোঃ শাহাদাত হোসেন, ড. সুব্রত সরকার, অধ্যাপক ড. এস এম শরীফুজ্জামান এবং অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী।
বৈশ্বিক উৎপাদনের ৭৬ শতাংশই বাংলাদেশে : গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ আহরণ করা হয় বাংলাদেশ থেকে। এক্ষেত্রে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যের আলোকে বলা হয়, ১৯৫০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ইলিশ আহরণ হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ২৩ হাজার ২৩৮ টন। এর মধ্যে ৯৭ লাখ ৫ হাজার ৫৭০ টনই বাংলাদেশ থেকে আহরণ করা হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক উৎপাদনের ১৫ শতাংশ মিয়ানমার এবং ভারত মাত্র ৪ শতাংশ আহরণ করেছে। বাকি ইলিশ আহরণ করেছে ইরাক, ইরান, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান। এছাড়া মালয়েশিয়ায়ও ইলিশের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে ইলিশ আহরণ করে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫০১ মেট্রিক টন। ২০১৯ সালে যা উন্নীত হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টনে। চলতি বছর ইতোমধ্যে আনুমানিক সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন আহরিত হয়েছে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরী।
ইলিশ বেশি মেঘনা অববাহিকায় : গবেষকদল বঙ্গোপসাগরের ৩ দশমিক ৫৬৮ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে তিন ভাগে বিশ্লেষণ করে মেঘনা অববাহিকায় ইলিশের উৎপাদন বেশি লক্ষ্য করে। গবেষণায় মেঘনা অববাহিকা ও মিয়ানমারের ইরাবতী অববাহিকার শূন্য দশমিক ১৩১ থেকে শূন্য দশমিক ২১৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবার মেঘনা ও ইরাবতী অববাহিকাসহ বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম সীমান্তবর্তী (ভারত উপকূল সংলগ্ন) এবং পূর্ব সীমান্তবর্তী (বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড উপকূল সংলগ্ন) শূন্য দশমিক ৩৭৩ থেকে শূন্য দশমিক ৮৬১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মাঝারি উৎপাদনশীল অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া গভীর ও দূর সমুদ্রের ২ দশমিক ৫১৭ থেকে ৩ দশমিক ০৪০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার সর্বনিম্ন উৎপাদনশীল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশের খাবার উদ্ভিদকণার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এসব পুষ্টি উপাদানের মধ্যে সিলিকেটের অত্যধিক ঘনত্ব গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও ইরাবতী অববাহিকাসহ উত্তর বঙ্গোপসাগরজুড়ে রয়েছে। তবে ইরাবতী অববাহিকার তুলনায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় নাইট্রেট ও ফসফেটের সমৃদ্ধি অনেক বেশি। এছাড়া গঙ্গা ও তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে সারা বছরই বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদকণা ভেসে আসে। তা মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়।
এছাড়া গবেষক দল আগস্ট-নভেম্বর মাস এবং জানুয়ারি-মার্চ মৌসুমে মেঘনা অববাহিকায় উদ্ভিদকণার প্রাচুর্য লক্ষ্য করে। এর মধ্যে আগস্ট-নভেম্বর মৌসুমে উদ্ভিদকণার প্রাচুর্যের সাথে ইলিশ আহরণের সম্পর্ক রয়েছে। তাই এ সময়ে বছরের ৮০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে। আবার জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত উদ্ভিদকণার প্রাচুর্য ইলিশের জাটকা বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বলে গবেষণায় জানা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, বঙ্গোসাগরের নদী অববাহিকা অঞ্চলে পুষ্টি উপাদান ও উদ্ভিদকণার প্রাচুর্য জলীয় খাদ্যচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে জীব যোগাযোগের সুষম বিন্যাস নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে পারস্পরিক প্রজনন, খাদ্য আহরণ, বিচরণ ও অবাধে চলাচলের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলেছে।
গবেষণায় মেঘনা ও ইরাবতী অববাহিকায় সর্বোচ্চ প্রাণিকনার উপস্থিতি দেখা গেছে, যা বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম এবং পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে প্রাণিকনার উপস্থিতি সর্বনিম্ন পাওয়া গেছে।
গবেষক দল বলছেন, মোহনা অঞ্চলের উপযুক্ত পরিবেশ ও খাদ্যের প্রাচুর্য ইলিশের পোনা ও জাটকা বেড়ে ওঠার উপযোগী হওয়ায় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রধান প্রজনন সংঘটিত হয়। এরপর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ইলিশ বঙ্গোপসাগরে গমন করে এবং সমুদ্রে বিচরণ করে।
এছাড়া মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী ও উপকূলবর্তী অগভীর অঞ্চলে মার্চ পর্যন্ত ইলিশের জাটকা বিচরণ করে এবং বেড়ে ওঠে। এপ্রিল মাসে ইলিশের ঝাঁক সমুদ্রে যাত্রা করে। এক্ষেত্রে দৈনিক ৭১ কিলোমিটার গতিতে উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এপ্রিল-জুলাই মাস পর্যন্ত পরিণত হওয়ার জন্য ইলিশ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করে। এরপরই নদী-মোহনামুখী প্রজনন যাত্রা শুরু করে।
গবেষকের বক্তব্য : গবেষক দলের সদস্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুব্রত সরকার আজাদীকে বলেন, ইলিশের খাদ্য তালিকায় ৯৭ থেকে ৯৮ ভাগ হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন এবং দুই থেকে তিন ভাগ হচ্ছে জুপ্লাংটন। তার মানে যেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি থাকবে সেখানে ইলিশ আসার সম্ভাবনাও বেশি। মেঘনা অববাহিকা এবং মিয়ানমারের ইরাবতী অববাহিকায় ফাইটোপ্লাংটনের প্রোডাকশন সবচেয়ে বেশি। কাজেই সেখানে ইলিশের প্রাচুর্যও বেশি হচ্ছে। সহজভাবে বললে খাবার বেশি হওয়ায় ইলিশ আসে এবং আমরাও বেশি ইলিশ পাই।
তিনি বলেন, ফাইটোপ্লাংটনের ঘনত্ব কম হওয়ায় দূর সমুদ্রে ইলিশের উৎপাদনও কম হয়। তবে এটা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, পৃথিবীর মোট ইলিশের ৭৬ ভাগই উৎপাদন করে বাংলাদেশ। পুরো বিশ্বে ইলিশের সর্বোচ্চ উৎপাদক হিসেবে একক কৃতিত্ব আমাদের। এটা অনেক বড় পাওয়া।
ইলিশের উৎপাদন ধরে রাখতে কি কি সুপারিশ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দূষণ বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। বিভিন্ন ধরনের অয়েল পলিউশন হয়, সেগুলো রোধ করতে হবে। তবে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোও কিন্তু ইতিবাচক ভূমিকা রাখেছে। যেমন কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ, প্রজনন সময়ে ইলিশ আহরণ নিষেধ এবং ইলিশের অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়েছে। মনুষ্য সৃষ্ট যেসব কারণে পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে সেগুলো যদি কমানো যায় তাহলে ইলিশের প্রাচুর্য ধরে রাখা যাবে।