পুলুম- হারিয়ে যাওয়া অনেক গ্রামের একটি
গ্রাম-প্রধান দেশ বাংলাদেশ হলেও শহরে জন্ম ও বেড়ে উঠার কারণে গ্রামের সাথে আমার নিবিড় পরিচয় ছিল তেমনটা দাবি করতে পারিনে। স্কুল-বয়সে মাঝে মধ্যে গ্রামে যাওয়া হতো মা-বাবার সাথে। এরপর যখন একা একা গ্রামে যাবার মত ‘বড়’ হয়ে গেলাম, তখন বাবার বাড়ির চাইতে মামার বাড়ি যেতাম বেশি। তার অন্যতম কারণ, সেখানে ছিল অবাধ স্বাধীনতা। তার উপর মামার গ্রামে ছিল একমাত্র পিসীর বাড়ি। চার পিসতুতো ভাইয়ের সবার ছোট, ডাকনাম সোনা, সে ছিল আমার সমবয়েসী। তাই অই গ্রামে গেলে পিসি-বাড়িতে থাকা হতো বেশি। মামা বাড়ি, পিসী বাড়ি-দুটিতেই যত্ন-আত্মীর কমতি ছিল না। একদিকে শহুরে-ভাগ্নে, অন্যদিকে ভাইপোকে কী খাওয়াবে, কোথায় রাখবে এই নিয়ে দু-দিকেই ব্যস্ততার শেষ ছিল না। আর এই বাড়তি যত্ন-আত্মীর কারণে মামার গ্রামে যাওয়ার আকর্ষণ ছিল নিজ গ্রামের চাইতে বেশি। নিজ গ্রামে ছিলেন কেবল বড় জেঠা, যার ধারে-কাছে আমরা সেই ছোটবেলা থেকে ভিড়তাম না। তার মেজাজ ছিল সর্বক্ষণ চড়া। নিঃসন্তান এই জেঠাকে, যাকে আমরা বড় জেঠা বলে ডাকতাম, আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে আশ-পাশ গ্রামের সবাই বেশ সমীহ ও শ্রদ্ধা করতো। গ্রামের শালিসীতে তাকে দেখেছি ‘রায়’ দিতে। বাকি যে দুই জেঠা ছিলেন (মেজ ও ছোট জেঠা) তারাও শহরে থাকতেন, পেনশনে যাবার আগ তক। বড় জেঠা অনেক আগেই সরকারি চাকরি থেকে পেনশনে গিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে উঠেছিলেন। বাবাকে যিনি ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন সেই নিঃসন্তান ঠাকুরমা, যাকে বাবা ‘মা’ ডাকতেন, তিনি ছিলেন একা। কখনো-সখনো গ্রামে গেলে তিনি তার ভাঙা-শরীর নিয়ে মাটির চুলোয় মাটির হাঁড়িতে রান্না করে আদর করে মাটিতে বসিয়ে খাওয়াতেন। স্কুল বয়সে এই ছিল গ্রামের সাথে আমার পরিচয়। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষের সময়টা থেকে গ্রামের ভিন্ন রূপ ধরা পড়ে আমার চোখে। তখন একা, কখনো সহপাঠীদের নিয়ে গ্রামে গেছি বেড়াতে, কখনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, কারো বিয়ে উপলক্ষে, এমন কী পাশের গ্রাম, ঠেগরপুনির বাৎসরিক মেলায়। বিকেলে, সন্ধ্যে বেলায় মামার বাড়ির সামনে পুকুর-পাড়ে সান-বাঁধানো ঘাটে বসে কত আড্ডা দিয়েছি। মামা কিংবা দাদুর সাথে সামান্য দূরে আমজুরহাট, কখনো বা মৌলভীরহাটে গেছি বাজার করতে। মনে পড়ে মাছের বাজারে গেলে আমাকে একদিকে দাঁড় করিয়ে দাদু যেতেন মাছ কিনতে। ওদিকটায় কাদা, তাই শহুরে নাতিনকে সাথে না নেয়া। ফেরার সময় তেলে ভাজায় এক ধরনের ‘বড়া’ কিনতেন আমার জন্যে। তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে তার পিছু পিছু মামা-বাড়ি ফিরতাম। দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন আমার দাদুটিও ছিলেন কড়া মেজাজের। মাস্টারি করতেন হাবিলাসদ্বীপ হাই স্কুলে। ফলে তার কাছেও খুব একটা ভিড়তাম না। তাকে হাসতে দেখেছি খুব কম। সবার সাথে তিনি কেমন যেন কড়া মেজাজে কথা বলতেন। পরীক্ষার খাতায় ছাত্রদেরও নাম্বার দিতেন কম। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরতেন একগাদা খাতা বগলে নিয়ে। হাতে থাকতো সব সময় কালো ছাতা। একবার তার অবর্তমানে শ্রেফ কৌতূহলের বশে বাড়িতে আনা পরীক্ষার খাতা খুলে দেখতে থাকি। দেখি বেশ কয়েকটি খাতায় তিনি কাউকে ৩১, কাউকে ৩০ দিয়েছেন। তখন ৩৩ ছিল পাস-মার্ক। দেখে কষ্ট হলো, মাত্র ২/৩ নম্বরের জন্যে ছাত্রগুলো ফেইল করবে। পাশেই ছিল পেন্সিল, যেটি দিয়ে তিনি ‘মার্কস’ দিতেন। দেরি না করে নম্বর বাড়িয়ে যে ক’টি ছাত্র ফেইল করেছিল দুই-তিন নম্বরের জন্যে সবাইকে ৩৩ করে দিলাম। (অপ) কর্মটি করে যেভাবে ছিল সেই মোটা সুতা দিয়ে খাতাগুলো বন্ধ করে রেখে দিলাম। মনে মনে এক ধরনের শান্তি পেলাম। মনে হলো একটি ভালো কাজ করেছি।
গ্রামে জন্ম না নিলেও গ্রামের অনেক সুখকর, মজার মজার ঘটনা, অভিজ্ঞতা আছে। তবে এই যে গ্রামের কথা লিখছি তা মনে এলো চমৎকার বর্ণনায় একটি অচেনা গ্রামের কাহিনী পড়তে গিয়ে। বইটির লেখকের সাথে সাক্ষাৎ এই দেশে, ইউরোপে। পেশায় তিনি শিক্ষক। তার জন্ম ও বড় হয়ে উঠা গ্রামে। তার গ্রামের নামটি আর পাঁচ-দশটি গ্রামের মত নয়, একেবারে ভিন্ন, ‘পুলুম’। আমার ধারণা আপনারা যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের কেউ এই গ্রামের নাম আগে শোনেননি, আমার মত। মাগুরা জেলার শালিকা উপজেলায় চিত্রা নদীর তীরে এই গ্রাম। ‘পুলুম আমার গ্রাম আমার আনন্দ-বেদনা’ বইটিতে লেখক, অধ্যাপক খোন্দকার ইনামুল কবীর তার গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন কতকগুলো বিষয়ের অবতারণা করেছেন যার কিছু দেখা হলেও তেমন করে জানা হয়নি। ‘দেখা’ আর ‘জানার’ মাঝে তো অনেক ফারাক, তাই নয় কি? একটি গ্রামের এমন নিখুঁত বর্ণনা, এত ‘ডিটেইল্ড’, আমি আর কোথায়ও পাইনি। আমারও ছোটবেলায়, স্কুল বয়সে যখন গ্রামে বেড়াতে যেতাম, এমন ঝড়ের দিনে ঝড়ো হাওয়া থেমে গেলে আমরা যেতাম আমতলায়। কুড়াতাম ঝড়ে পড়ে-থাকা আম। এমনি এক ঝড়ো দিনে আম কুড়োতে গিয়ে আট/ন’ বছরের অনিমার সাথে দেখা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এক মেঘলা বাদল-দিনে দুটি মেয়ে আম কুড়োতে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনের ‘উত্তরায়ণে’। এমন সময় এলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মেয়ে দুটি আশ্রয় নেয় ‘শ্যামলীর’ বারান্দায়। কবিগুরু সে সময় সেখানে বসে লিখছিলেন। নাম জিজ্ঞেস করতে একজন বলে, ‘অনিমা’। কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গান জানো’? অনিমা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তেই কবি বলেন, ‘বেশ ধরো’। অনিমা ধরলো কবির লেখা বর্ষার একটি গান। কবির খুব পছন্দ হলো। এই মেয়েটির নাম তিনি পরে বদলে রাখলেন ‘কণিকা’, যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন রবীন্দ্র সংগীতে কিংবদন্তী, কণিকা বন্দোপাধ্যায়। গ্রামে আম কুড়ানোর সুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কোথায় চলে এলাম। কেবল পুলুমে নয়, বোধকরি খুব কম গ্রামেই এই ‘আম কুড়ানোর সুখ’ এখন আর বর্তমান আছে। গ্রামগুলো তাদের মূল সৌন্দর্য্য, রূপ, লাবণ্য সব হারিয়েছে। ধারণ করেছে কৃত্রিম চাকচিক্য, গায়ে চড়েছে মেকআপ। এখন আর চোখে পড়ে না সান-বাঁধানো ঘাটে স্নান সেরে জল থেকে উঠে আসা রমণী বা কিশোরীকে, কিংবা দল বেঁধে গাছের ডাল থেকে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়া ছেলেদের দল। এখন আর চোখে পড়ে না দল বেঁধে গ্রামের মেয়ে-বধূদের কলসী কাঁখে খাবার জলের জন্যে পুকুর-পাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এখন আর চোখে পড়ে না রাতের আঁধারে জোনাকির ডানা মেলে নৃত্যের দৃশ্য। মনে মনে গেয়ে উঠতে পারিনে, “ও জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছো/আঁধার সাঝে বনের মাঝে, উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছো”।
কয়েক সংখ্যা আগে এই কলামে শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে তালগাছের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এই তালগাছের বর্ণনা এসেছে খুব সুন্দর করে ‘পুলুম’ গ্রামের বর্ণনায়। লেখকের সাথে আলাপে টের পাই তার রসবোধের, সংগীতের প্রতি তার অনুরাগের। সেই রসবোধের সাক্ষাৎ পাই তালগাছ সম্পর্কে তার বর্ণনায়, যখন তিনি পুরানো প্রবাদের কথা তুলে বলেন, ‘তুমাগের সব কতাই মানি, তয় তালগাছটা আমার সীমানায় রাইহে আইল ভাগ করবা।’ শীতকালে শীত কম পড়লে খেজুর গাছ থেকে কম রস গলে- বিষয়টা জানা থাকলেও, গ্রীষ্মকালে কম গরম পড়লে তালগাছে যে কম রস গলে সেটি জানলাম অধ্যাপক খোন্দকার ইনামুল কবীরের বইটি পড়ে। অনেক অজানা বিষয় তিনি সাবলীল বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। যেমন তালগাছের যে ‘স্ত্রী-পুরুষ’ ভেদ আছে সেটিও জানা ছিল না। আসলে জগতের কত কিছুই তো অজানা। পুরুষ তালগাছ থেকে রস নামাতে বেশ কষ্ট। স্ত্রীবাচক গাছের তালের কাঁদি থেকে রস বের করা সহজ। অর্থাৎ তালের গাছের ব্যাটা-বাচককে নমনীয় করতে হয়, আর বেটি-বাচক নিজেই নমনীয় থাকে -সেই বর্ণনা দিয়েছেন লেখক রসবোধের মধ্যে দিয়ে, পড়তে বেশ ভালোই লাগে। সত্তরোর্ধ এই লেখকের সাথে দেখা হল্যান্ডে, গেল বছর। সস্ত্রীক এসেছিলেন তার কূটনৈতিক-সন্তানের (কাউন্সিলর খোন্দকার এহতেশামুল কবীর) কাছে কিছুদিন থাকবেন বলে। মাস কয়েক ছিলেন। সেই সূত্রে তার সাক্ষাৎ এবং আলাপ। মেধাবী এই শিক্ষক যশোহরের মাইকেল মধুসূদন কলেজে উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসরে যান।
এক সন্ধ্যেয় আমার বাসায় এসেছিলেন। আমার লেখা একটি বই নিয়ে নাড়ানাড়ি করছিলেন। সেদিন বাসায় ছিল কিছু অতিথির ভিড়। তারই এক ফাঁকে তিনি বইটি নিয়ে এলেন আমার কাছে। পাশের চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা খুলে একটি পাতা দেখিয়ে বললেন, ‘মনে হয় এই শব্দটি এইভাবে না হয়ে ঐভাবে (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না কোন শব্দের কথা বলেছিলেন) হলে ভালো ও সঠিক হতে বলে মনে করি’। কেন-তার যুক্তিও তিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অতিথির ভিড়, অনেকের কথার ভিড়ে ঠিকমত ধরতে পারিনি। তাতে আমি তার মাঝে এক ধরনের গ্রাম্য সরলতার ছোঁয়া পেয়েছি। বুঝি শিক্ষক হলে এমনই হয়। হওয়া উচিত। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ভোলেননি। দেশ থেকে অনেকেই আসেন হল্যান্ডে। আত্মীয়, বন্ধু, অপরিচিত অনেকেই। ওনারা আসেন, কেউ কেউ থাকেন, আমাদের সাথে ঘুরেন। এদের অনেকেই দেশে পৌঁছে সৌজন্যমূলক একখানা বাক্য পাঠান না, ধন্যবাদ জানিয়ে। কিন্তু সরলমনা, আমার বাবার বয়েসী (বাবা মারা গেছেন ৬৮ বছর বয়সে) এই শিক্ষক যাকে ‘কিছু করার’ কোন সুযোগ আমার হয়নি, তিনি দেশে ফিরে গিয়ে ‘করোনার’ এই দুঃসময়ে, যখন কেউ কারো সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে পারছেন না, সেই সময়, সেই বৈরী পরিস্থিতিতে যশোর পৌঁছে কিছুদিনের মাথায় আমার জন্যে পাঠিয়েছেন, তার লেখা বই, ‘পুলুম আমার গ্রাম আমার আনন্দ-বেদনা’। আমি আপ্লুত হয়েছি। কেবল তাই নয়, দেশ থেকে ফোন করেছেন ইতিমধ্যে বার কয়েক। কথা বলেছেন। বলেন, ‘হল্যান্ডে যে ক’জনের সাথে পরিচয় হয়েছে তার মধ্যে আপনাকে মনে খুব ধরেছে, অনেকদিন মনে থাকবে’। তারপর যা আমার প্রাপ্য নয় তেমন অনেক প্রশংসার শব্দাবলী, এখানে তার উল্লেখ করলাম না। জীবনে চলার পথে অনেকের সাথে দেখা হয়, ঘটে পরিচয়। অনেকেই হারিয়ে যান, একেবারে, চিরদিনের তরে। আবার অনেকেই চলে যান, কিন্তু টেনে যান রেখা, রেখে যান এমন কিছু মুহূর্ত যা তাদের ভুলতে দেয় না। তাদের একজন প্রবীণ শিক্ষক ও লেখক। তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। লেখক : সাহিত্যিক, কলাম লেখক