শেখ রাসেল মা’র কাছে যেতে চেয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মা। সেই মা’র কাছে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। ছোট্ট রাসেলের কোন অপরাধ ছিল না। দশ বছরের শিশু কী অপরাধ করতে পারে? একদল হিংস্র সেনা অফিসার তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। শেখ রাসেলের বাবা, মা, ভাই, ভাবীসহ পরিবারের ২০ জনকে ওরা হত্যা করে। অমন নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করতে ওদের বুক একটুও কাঁপেনি। বুক কাঁপেনি পরিবারের ২০ জন মানুষকে হত্যা করতে!
দাদুর কাছে এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে তনু চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথাই বলছে না সে। এক দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে জানালার ওপারে হাসনাহেনার ডালে তিনটি শালিক ডানা ঝেড়ে কী যেন বলতে চাইছে। কী বলছে ওরা? সে কথাই বোঝার চেষ্টা করছে তনু। তনু কি পাখিদের ভাষা বোঝে? দাদু বেশ অবাক হয়ে তনুকে ডাকে, “এই দাদুভাই এতো কী ভাবছো বল তো?’’ তনু কোন উত্তর দেয় না। এক সময় জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় সে। শালিকগুলো তখনো ডানা ঝাড়ছে আর কিচি মিচি করে কী যেন বলছে। সে ভাষা দাদু না বুঝলেও তনু বুঝতে পারে। সে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কান পাতে হাসনাহেনা গাছের দিকে। একটি শালিক বলছে, “যারা আমাদের বন্ধু রাসেলকে মেরেছে তারা খুব খারাপ। তাদের আমরা অভিশাপ দিচ্ছি। ওরা কখনো সুখি হবে না। ওদের পরিবারের কেউ সুখি হবে না। আমরা আমাদের বন্ধুদের জানিয়ে দেব। খুনীদের যেন কেউ ক্ষমা না করে।’’ তনু পাখিদের কথা শুনে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাসনাহেনা গাছের খুব কাছে এসে চুপি চুপি দাঁড়ায় সে। শালিকেরা ভয় পেয়ে উড়ে যায় না। বরং তার খুব কাছে এসে বসে। একটি শালিক তনুর নাম ধরে বলে, “ তুমি তো তনু তাই না ? ঠিক শেখ রাসেলের বয়সী। রাসেলও মৃত্যুর আগে তোমার মতই ছিল। আহারে রাসেল সোনা। মা’র কাছে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দানবেরা তাকে মা’র কাছে যেতে দেয়নি। ’’ এই কথা বলেই শালিক তিনটি চিঁ চিঁ করে কাঁদতে শুরু করলো। পাখিদের কান্না শুনে তনু নিজেকে সামলাতে পারল না। সেও কান্না শুরু করে। অনেকক্ষণ কাঁদলো তনু । এক সময় দাদু এসে পাশে দাঁড়ায়। তনুর দুচোখে জলের ধারা দেখে তার চোখ মুছে দেন দাদু। দাদু বলেন, ’’ কেঁদো না দাদুভাই। কেঁদো না। আমি জানি রাসেলের জন্য তোমার মন খারাপ করছে। মন খারাপ করো না। বরং প্রতিজ্ঞা করো আর কোনও শিশুকে এভাবে যেন চলে যেতে না হয়। আর কোন মানুষরূপী দানব যেন এমনটি করতে না পারে। ’’ শাওন নিজেকে সামলে নেয়। সে যে পাখির ভাষা বুঝতে পেরে কেঁদেছে এ কথা দাদুকে কিছুতেই বুঝতে দেয় না। দাদু ভেবেছে, তার কাছে রাসেলের করুণ ইতিহাস শুনেই তনু এমনভাবে মন খারাপ করেছে, কেঁদেছে।
রাতে টেবিলে বই রেখে তনু পড়তে বসে। কিন্তু পড়াতে মন বসছে না তার। বাংলা পাঠ্য বইয়ের পাতা উলটে রাসেলের ছবি বের করে সেখানে হাত বুলায় সে। কত মায়াময় চেহারা রাসেলের। সাইকেলে টুং টাং শব্দ করে বাড়ির উঠানো ছুটে বেড়াত সে। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ব্যস্ত থাকতেন। সেই ব্যস্ততার মাঝেও তিনি রাসেলকে কাছে ডেকে নিতেন। পাশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। পাশে থাকতো তার মা, হাসু আপু আর রেহানা আপু। বাবার কাছে গল্প বলার বায়না ধরতো রাসেল। বাবা গল্প শোনাতেন। দেশের গল্প, বিদেশের গল্প। নিজের ছেলেবেলার গল্প। সেই গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়তো ছোট্ট রাসেল সোনা।
এসব কথা দাদুর কাছে শুনেছে তনু । দাদু নাকি রাসেলের বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছেন। দাদু মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করেছেন। যুদ্ধ করেছেন দাদুর মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। তাইতো আজ আমরা স্বাধীন। বাংলায় কথা বলতে পারছি। লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে গলা মিলিয়ে গাইতে পারছি “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’’ যে স্্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন রাসেলের বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এত কিছু জানেন দাদু ? তনু অবাক হয়। “আমিও বড় হয়ে অনেক কিছু জানবো। শিখবো।’’ প্রতিজ্ঞা করে তনু । সেই প্রতিজ্ঞায় বিভোর হয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
তনু রাসেলের বন্ধু হতে চায়। ধীর পায়ে রাসেলের কাছে এগিয়ে যায় সে। রাসেল তনুর হাত ধরে তার সাইকেলের পেছনে উঠিয়ে নেয় তাকে। টুং টাং টুং টাং সাইকেল চলতে থাকে। এক সময় বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় চলে আসে ওরা। রাস্তা ফাঁকা। কোন জন-মানব নেই, গাড়ি-ঘোড়া নেই সেখানে। দুজনের আলাপ বেশ জমে ওঠে। “ তুমি কোন ক্লাসে পড়ো রাসেল ? ’’ রাসেলকে জিজ্ঞেস করে তনু । রাসেল জবাব দেয় না। আবার জিজ্ঞেস করে , “ রাসেল তোমাকে ওরা মারলো কেন ? ’’ প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ায় রাসেল। “কই আমি তো মরিনি। এই যে, তোমার সাথে আছি। সাইকেল চালাচ্ছি।’’ “ও তাই তো ।’’ তনু বলে ওঠে। হঠাৎ একটি মিলিটারি ট্রাক ওদের সামনে এসে থামে। দু’তিনজন লম্বা গোঁফওয়ালা মিলিটারি এসে রাসেলকে ট্রাকে তুলে নেয়। ট্রাক ছুটে চলে অজানা গন্তব্যে। তনু চিৎকার করে ওঠে। “রাসেলকে নিও না। নিও না। রাসেল আমার বন্ধু। রাসেল, রাসেল ’’ বলে চিৎকার করে ওঠে তনু ।
দুম করে শব্দ শুনে দৌড়ে আসেন তনুর বাবা-মা আর দাদুভাই। ওরা দেখেন তনু চেয়ার থেকে নিচে পড়ে হাত-পা ছুড়ছে। আর বলছে, “ রাসেলকে নিও না। নিও না। রাসেল আমার বন্ধু।’’ আর কাঁদতে থাকে। দাদু তনুকে মেঝে থেকে তোলেন। “ কী হয়েছে দাদু ভাই ? স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি ? ’’ চোখ রগড়ে উঠে বসে তনু । তার ঘোর কাটছে না কিছুতেই। টেবিলে রাখা পাঠ্য বইয়ের পাতায় রাসেলের ছবিটা দাদু ভাইয়ের চোখে পড়ে। তিনি বইটা গুটিয়ে রাখেন।
দাদুভাই সব বুঝতে পারেন। তনুকে রাসেলের গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি। রাসেলের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ মেনে নিতে পারছে না সে। সারাক্ষণ তাই ভেবে এমনটি ঘটেছে। রাসেলের কপালে হাত বুলিয়ে দেন দাদু। দাদু বলেন, “ আগামীকাল পনেরই আগষ্ট। রাসেলের মৃত্যু দিবস। তুমি রাসেলকে নিয়ে একটি ছড়া লিখে স্কুলে যাও। স্কুলের অনুষ্ঠানে ছড়াটি আবৃত্তি করে সবাইকে শোনাও। দেখবে রাসেল তোমার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। সে তোমার বন্ধু। বন্ধু কখনো বন্ধুর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না। রাসেল আছে। রাসেল থাকবে। রাসেলরা কখনো মরে না। রাসেল বেঁচে আছে তোমাদের মাঝে লক্ষ লক্ষ শিশুর মাঝে।’’ দাদুর কথায় তনুর ঘোর কাটে।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দৈনিক কাগজের পাতায় একটি ছড়া খুঁজে পায় সে। ছড়াটি বার বার আবৃত্তি করে।
রাসেল সোনার জন্য কাঁদে বনের যত পাখি,
ফুলবাগানে ফুল কেঁদে কয়, রাসেল এলে নাকি ?
ধানমণ্ডির লেকে কাঁদে ফড়িং প্রজাপতি,
সোনার ছেলে রাসেল ওদের কী করেছে ক্ষতি ?
রাসেল সোনার কান্না সবার বুকের ভেতর বাজে
অমন ছেলে মিলবে কোথায় লক্ষ ছেলের মাঝে।
হ্যাঁ, এই ছড়াটি তনু কাল স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবে। ছড়াটি ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দেয় সে। ঘুম আসছে না সহজে। কখন সকাল হবে, সে অপেক্ষায় রাতের কোলে নিজেকে সঁপে দেয় তনু।