পাহাড়জুড়ে এখন শরতের উৎসব। আকাশজুড়ে নীল আকাশের ভেলা। কোথাও কোথাও কাশবনের সাদা ফুল উড়ে যায় বাতাসে টানে। সকালের কুয়াশাঘেরা পাহাড় দিনের শুরু থেকেই তপ্ত হতে থাকে। এমন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বেড়েই চলেছে তাপদাহ। দিনের শুরুতেই কাজের বেবিয়ে পড়েন জুমিয়ারা। চিরচেনা পাহাড়ের দৃশ্যপট এমনই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যায় স্রোতস্বীনি নদ, পাহাড়জুড়ে সবুজ, কোথাও কোথাও উড়ে যায় মেঘ, বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় তেপান্তর, ঝরণার কলতান এখানে নিয়মিত সুর বাঁধে। পাহাড়ের চেনা পথে চলতে চলতে কখনো কখনো ক্লান্ত পথিক থমকে দাঁড়ায়। ঝড় বৃষ্টি বা তীব্র রৌদে লোকালয়হীন পথে একটু বিশ্রাম নেয়াটা অনেক সময় আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই পাহাড়ের পথে পথে দেখা মিলে রঃফুং জাং বা রঃফুং চা যা পরবর্তীতে বিশ্রামাগার, ধর্মঘরসহ বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম বা পাহাড়ি জনপদের মানুষের অবসর কাটানোর রঃফুং জাং বা রঃফুং চা গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বিষাদময় ইতিহাস।
প্রাচীন ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, মারমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে রঃফুং জাং বা রঃফুং চা বা ধর্মঘরের সূচনা করে। মারমা লোককাহিনী অনুসারে, ‘পাহাড়ে পথের ধারে বসবাস করত এক মারমা বৃদ্ধা। তার সাথে বসবাস করত একমাত্র ছেলে। পাহাড়ের খাদ থেকে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করত মারমা বৃদ্ধা। তবে ক্লান্ত পথিক বা পথচারী কখনো তৃষ্ণা মেটাতে পানি চাইলে বৃদ্ধা তাদের পানি পান করতে দিতেন না। এমনকি বৈরি আবহাওয়ায় কোনো পথচারী আশ্রয় বা বিশ্রাম করতে চাইলেও বৃদ্ধা আপত্তি জানাতেন। কখনোই পথচারীকে ওই বৃদ্ধা বিশ্রামের জায়গা দিতেন না। একদিন বৃদ্ধার একমাত্র ছেলে পানির পিপাসায় মারা যায়। বৃদ্ধা পাহাড়ের কুয়ো থেকে পানি নিয়ে আসতে আসতেই প্রাণ যায় ছেলের। বৃদ্ধা মনে করলেন-পথচারীদের পানির পিপাসা মেটাতে না দেয়া এবং বিশ্রামের সুযোগ না দেয়ায় প্রকৃতি বা স্রষ্টা তার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছেন, ছেলে মারা গেছে। সেই থেকে বৃদ্ধা যতদিন বেঁচে ছিলেন পথের ধারে মাচাং করে মাটির কলসিতে করে পানি রাখতেন। কালের পরিক্রমায় সেই বৃদ্ধার পানি রাখার সেই স্থান ‘ধর্মঘর’ নামে পরিচিতি পায়। তৃষ্ণার্থ পথিককে পানি পান করানো পূণ্যের কাজ।’
পরবর্তীতে পার্বত্য জনপদ লোকালয়ের পাশে এমন ধর্মঘর বা বিশ্রামাগার গড়ে তোলে মারমা এবং চাকমারা। তবে আর্থ সামাজিক বিকাশের পথ ধরে পানি রাখার সেই ধর্মঘর আরো বিস্তৃত হয়েছে। এসব ঘর মানুষের বিশ্রাম নেওয়ার জন্যও গড়ে তোলা হয়। কাঠের খুঁটি, বাঁশের মাচাং এবং টিনের ছাউনিতে গড়ে তোলা হয় এসব বিশ্রামাগার। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় চোখে পড়ে এসব মাচাংঘর। খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের মধ্যভাগে এমনই এক মাচাং ঘর দেখে থমকে দাঁড়ান এই প্রতিবেদক। বটবৃক্ষের ছায়া ঘেরা এসব ধর্মঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন পাড়ার লোকজন এবং পথচারী।
স্থানীয়রা জানান, মারমা অধ্যুষিত বেশির ভাগ লোকালয়ের পাশে ধর্মঘর বা মাচাংঘর গড়ে তোলা হয়েছে। অবসরে এখানে এসে পাড়ার মানুষ আড্ডা দেয়। এতে আমাদের সামাজিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। নিজের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করেন তারা। মহালছড়ির সিঙ্গিনালা যাওয়ার পথেও বৃক্ষছায়ায় এমন ধর্মঘর বা বিশ্রামাগার চোখে পড়ে। লেকের পাশে গড়ে ওঠা এসব মাচাংঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন পাড়ার বাসিন্দারা।
মারমা ভাষার কবি চিংলামং চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ের পথে পথে জনবসতি তুলনামূলক কম থাকে। বৈরি আবহাওয়ায় অনেক সময় পথচারীদের আশ্রয় নিতে হয়। মারমা বৃদ্ধার প্রবর্তিত সেই মাটির কলসিতে পানি খাওয়ার রঃফুং জাং বা রঃফুং চা বা ধর্মঘর এখন আরো বিস্তৃত হয়েছে।