কর্ণফুলী নদীর পাড় দখলকারীদের উচ্ছেদে শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এসময় তিনি কর্ণফুলী নদীর পাড়ের জমি শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মন্ত্রী বলেন, কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় সরকার বদ্ধ পরিকর। আমি জানি না, আপনারা কোন কন্টেক্সটে কর্ণফুলী নদীর পাড়ের জমিগুলো লিজ দিয়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ দিচ্ছেন।
‘কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, দখল ও দূষণ রোধে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন, চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন সংক্রান্ত’ আলোচনা সভায় মন্ত্রী এসব কথা বলেন। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সভার আয়োজন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, ওয়াসিকা আয়েশা খানম এমপি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, সিডিএ চেয়ারম্যান এম. জহিরুল আলম দোভাষ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ, পানি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শেখ মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ আহমদ তানভীর, ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক তাহেরা ফেরদৌস, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একে এম ফজলুল্লাহ, চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বক্তব্য রাখেন। সঞ্চালনা করেন বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ।
কর্ণফুলী দখল বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম আরো বলেন, এখন ব্যাপারটা হচ্ছে- কেউ কাউকে কিছু বলতে পারে না। মনে হয় যেন আমরা চোর-পুলিশ খেলছি। কে দখল করছে? তাজুল ইসলাম দখল করছে, নাকি রহিম উদ্দিন দখল করছে, না করিম উদ্দিন দখল করছে, না অমুক সাহেব তমুক সাহেব? যেই হোক না কেন ‘জাস্ট রেসকিউ দোজ ল্যান্ড’। তিনি বলেন, নদীর ৮০ কি.মি. জুড়ে অন্তত ৩শ’ কারখানা কিংবা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এগুলো এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে কারখানার বর্জ্য নদীতে চলে আসার আশংকা রয়েছে। পেপার মিল, তেল শোধনাগার, পাওয়ার প্লান্ট, ট্যানারি, সার প্রস্তুতকারক, সাবান এবং সিমেন্ট তৈরির কারখানা এরমধ্যে অন্যতম। এসব কারখানার তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) আছে কিনা খতিয়ে দেখা হবে। থাকলেও এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে কি না, তাও যাচাই বাছাই করা হবে।
এসময় তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর সবচেয়ে গর্বের একটা জায়গা। মহিউদ্দিন সাহেব (প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী) চট্টগ্রামের স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। উনার মধ্যে বেসিক দেশপ্রেম ছিল এবং এটা প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করতেন।
সারা বছর রাস্তা কাটা নিয়ে প্রশ্ন : নগরে সারা বছর রাস্তা কাটাকাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলে তিনি বলেন, উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে করতে হবে। ১০ টাকা বেশি খরচ হোক। কিন্তু প্রতিদিন করবেন এটা ঠিক না। তিনি বলেন, আজ ওয়াসার পাইপ লাইনের জন্য কাটা হলো, কাল বিদ্যুৎ এবং পরদিন কাটল গ্যাস। সুন্দর রাস্তা করা হয়, সেটা আবার পরদিন কাটা হয়। কেন? ধুলোবালিতে ভারী ধাতু উড়ছে। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ইটজ মাই ডেস্টিনি? এখানে নিউ টেকনোলজি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে না? রাস্তার পাশে বা মাঝখানে ঢাকনাযুক্ত লেন রাখতে হবে। যার দরকার সে ঢাকনা খুলে পাইপ লাইনের কাজ করুক। কাটাকাটি তো আর লাগবে না।
মেরিন ড্রাইভ হলে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে : সরকার চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মেরিন ড্রাইভ হলে এই অঞ্চলে নতুন হাজার হাজার হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, কলকারখানা সৃষ্টি হবে। চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ করতে পারলে সেটা হবে ইকোনমিক পটেনশিয়াল এরিয়া। এতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান তৈরি হবে অন্যদিকে পর্যটন খাতে খুলবে নতুন দিগন্ত। এটা বুঝতে রকেট সাইন্সের দরকার হয় না। চট্টগ্রামে যত সম্ভাবনা আছে, সেটাকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগান তাহলে এখানে টাকা সরকারকে দিতে হবে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম দৃষ্টি নন্দন শহর হবে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা এই নগরীতে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। উনি জানেন, চট্টগ্রামের পটেনশিয়ালিটি কী? এজন্য উনি চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা দিয়েছেন। আরো দিতে চান, যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি। তিনি বলেন, মহিউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছেন, তিনি সাপোর্ট পাননি। আগে ওনাকে জেনারেট করতে হচ্ছে, তারপর সেটা তিনি খরচ করছেন। এখন তো সরকার টাকা দিচ্ছে, সাপোর্ট দিচ্ছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? তাজুল ইসলাম উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করা যাবে না। এটি করা হলে পরবর্তীতে নগরবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে আমার জন্ম না, চট্টগ্রামে রাজনীতিও করি না। বঙ্গন্ধুর ফলোয়ার হিসেবে বাংলাদেশকে ভালোবাসি। চট্টগ্রাম সুন্দর হলেও আমার ভালো লাগে।
তিনি বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশনে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলীর নাব্যতা বৃদ্ধি, দখল ও দূষণ রোধে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন, অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে খাল উদ্ধার ও খনন, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চসিক প্রশাসকের উদ্যোগে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আরো বলেন, স্থানীয় সরকার মানুষের কল্যাণে যত কাজ সব করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্টের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। হোল্ডিং ট্যাঙ সবাইকে দিতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে অনেক স্লুইসগেট করবেন। এসব স্লুইচগেইট করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যাকে উন্নয়নকাজের দায়িত্ব দেয়া হবে, তাকে সঠিকভাবে করতে হবে। ওপর থেকে সুপারভাইজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখেন। পথনকশা তৈরি করেছেন। ঢাকাতে উন্নয়ন সীমাবদ্ধ রাখা হবে না। গ্রামেও পৌঁছে দেয়া হবে। আমরা অর্থনীতির শঙ্কার জায়গা থেকে বেরিয়ে গেছি। কোভিডের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও আমরা জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা মোকাবেলা করতে পারব। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০০০ সালেই সিঙ্গাপুর হতো। আমাদের প্রাকৃতিক সুযোগ রয়েছে। ঢাকার পাঁচটি নদী ও কর্ণফুলীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, অবৈধ দখল ও দূষণ বন্ধে কাজ করছি। ঢাকার বাইরে এটি প্রথম সভা।
সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই পার্সোনাল ইগোতে না নিয়ে জয়েন্টলি কাজ করি। যদি ভুল করি সেটা ধরাই দিবেন, আর আমিও আপনাকে এমনভাবে বলবো কেন মনে কষ্ট পাবেন? আর যদি সঠিকভাবে বলি কেন মনে কষ্ট পাবেন। আপনার রেসপনসিবিলিটি আপনাকে পালন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রায় সবকটিতে ওয়াসার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করছে। দৈনিক ৪২ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রাম ওয়াসা এখন ৩৭ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দিচ্ছে। চট্টগ্রামে আবাসিক গ্রাহকরা ১ হাজার লিটার প্রতি পানির জন্য দাম দিচ্ছেন মাত্র ১২ টাকা ৪০ পয়সা, ঢাকায় যেটি ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চট্টগ্রাম ওয়াসা চট্টগ্রামের ৪শ কি.মি. এলাকা নতুন সংযোগের আওতায় এনেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা যে প্রকল্পগুলো বাস্তবাবায়ন চলছে এসব সম্পন্ন হলে পানি ও পয়:নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম একটি আধুনিক নগরে পরিণত হবে। তিনি আরো জানান, শহরে প্রবেশ পথে কোনো ডাম্পিং স্টেশন হবে না। চট্টগ্রামের ফয়’সলেক এলাকাকে অপরাধ মুক্ত করা হবে।
সভায় পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি বলেন, চট্টগ্রাম নিয়ে মন্ত্রণালয়ের যে সকল প্রকল্প রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের পথে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। পর্যায়ক্রমে এসব প্রতিন্ধকতা দূর করা হবে। তিনি বলেন, ওয়াসার বিদ্যমান প্রকল্পে স্যুয়ারেজ সিস্টেম যেন কর্ণফুলী নদীমুখী না হয়। নদীকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমদ এমপি বলেন, চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতারই বহি:প্রকাশ। এগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমেই সম্পাদন করতে হবে। তা নাহলে এর সুফল থেকে নগরবাসী বঞ্চিত হবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম প্রকৃতপক্ষেই একটি প্রাকৃতিক শহর। তবে এর নানা অবকাঠামোগত দূর্বলতা রয়েছে। রাস্তাঘাটগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৬ টনের হলেও ৬০ টনের বোঝা নিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো একারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। তাই আমার প্রশ্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সাড়ে ৩শ কোটি টাকার বেশি তহবিল থেকে ১ শতাংশ হারে সিটি কর্পোরেশনকে দেবে না কেন? তাদের গৃহকর বাবদ পঞ্চবার্ষিকী কর পূন:মূল্যায়ন হলে সিটি কর্পোরেশনকে দেয় ট্যাঙের পরিমাণ দাঁড়াতো প্রায় ১ শ ৬০ কোটি টাকা। কিন্তু দিচ্ছে মাত্র ৩৯ কোটি টাকা। আমি মনে করি, এটা চট্টগ্রামবাসীকে বঞ্চিত করার আরেকটি অপপ্রয়াস। তিনি সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সিটি কর্পোরেশনের যে ম্যাচিং ফান্ড বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা থেকে চসিককে অব্যাহতি দেয়ার দাবি জানান।