নিয়ম নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি সিএনজিতে রূপান্তর এবং তাতে নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ফলে এসব গাড়ি যেন চলমান বোমায় পরিণত হচ্ছে। একই সাথে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজি সিলিন্ডারগুলো বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বা চৌদ্দ হাজার বার রিফিল করার পর সিএনজি সিলিন্ডার এবং ১০ বছর পর এলপিজি সিলিন্ডার রি-টেস্ট করানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যেন কেউ মানছে না। এছাড়া সিলিন্ডারে নেই প্রস্তুত কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ। যানবাহন মালিকদের অনীহা, এলএনজি ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি এবং সর্বোপরি প্রশাসনের উদাসীনতায় গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে পরিস্থিতি ক্রমে নাজুক হয়ে উঠছে। একটা সিলিন্ডার প্রস্তুতের পর অনন্তকাল ধরে ব্যবহারের প্রচলিত ধারাই এই খাতের বড় হুমকি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এবং গ্যাস সেক্টরের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে শুরু করে যানবাহন, অফিস থেকে দোকানপাট পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। এক সময় বিদেশ থেকে সিলিন্ডার আমদানি করে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে দেশে প্রচুর সিলিন্ডার তৈরি হচ্ছে। মানসম্পন্ন সিলিন্ডারের পাশাপাশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের পাইপের জোড়াতালি দিয়ে সিলিন্ডার তৈরি করার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রজ্ঞাপন ও সিএনজি বিধিমালা-২০০৫ অনুসারে সিএনজি চালিত যানবাহনের সিলিন্ডার স্থাপনের পাঁচ বছর অন্তর বা চৌদ্দ হাজার বার রিফিল করার পর পুনঃপরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ সিলিন্ডারের খুবই স্বল্প সংখ্যকের রি-টেস্ট করা হয়। সিলিন্ডার রি-টেস্ট সনদ দেয়া না হলে গাড়ির ফিটনেস আটকে দেয়ার একটি নিয়ম করেছিল বিআরটিএ। পরবর্তীতে ওই নিয়ম শিথিল হয়ে যায়। এতে দেশের কয়েক লাখ যানবাহনে অন্তত ১৫ বছরের বেশি পুরনো গ্যাস সিলিন্ডার থাকলেও তা নিয়ে কারো যেন কোনো মাথাব্যথাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহৃত হচ্ছে এসব সিলিন্ডার।
অপরদিকে বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ না দেয়া ও গ্রামগঞ্জে লাকড়ির ব্যবহার কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গৃহস্থালীর পাশাপাশি হোটেল রেস্তোরাঁয়ও চলছে এলপিজি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলপিজি লিমিটেড বছরে অন্তত ১৪ লাখ সিলিন্ডার বাজারজাত করে। এটি দেশের এলপি গ্যাসের চাহিদার ৩ শতাংশেরও কম। এছাড়া অনুমোদিত অন্তত ২৫টি প্রতিষ্ঠান কয়েক কোটি এলপিজি সিলিন্ডার রিফিল করে বাজারজাত করে। বিদেশ থেকে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানির পাশাপাশি দেশে সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী ১৬টি প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে অন্তত তিন লাখ সিলিন্ডার উৎপাদন এবং বাজারজাত করে। বছরে ৩৬ লাখ এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই। এর বাইরে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড এবং তুরস্ক থেকেও প্রচুর এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, এই পরিসংখ্যান থেকেই অনুমান করা যায়, দেশে গ্যাসের ব্যবহার কী পরিমাণ বেড়েছে। বেড়েছে সিলিন্ডারের ব্যাবহার। বাজারে সাড়ে ১২ কেজি, ৩০ কেজি ও ৩৫ কেজিসহ বিভিন্ন মাপের সিলিন্ডার রয়েছে। এসব সিলিন্ডার ঘরে ঘরে গ্যাসভর্তি হয়ে গেলেও এগুলোর অধিকাংশরই কোনো মেয়াদকাল নেই। যতদিন পর্যন্ত সিলিন্ডারগুলো নষ্ট হয়ে না যায় বা কোনো অঘটন না ঘটে ততদিন সেগুলো রিফিল হতে থাকে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিন হাবিব বিডি লিমিটেডের পরিচালক, সাবেক চেম্বার পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, উৎপাদিত সিলিন্ডারে কোনো মেয়াদকাল থাকে না। তবে সচরাচর একটি সিলিন্ডার ১০/১২ বছর ব্যবহার করা যায়। উৎপাদনের তারিখ না থাকলে ১০/১২ বছর নির্ধারণ কিভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে সবাইতো একইভাবে করছেন।
এই ব্যাপারে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রাণাধীন এলপিজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমান গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের সিলিন্ডারগুলোর নিয়মিত রি-টেস্ট করা হয়। একবার রি-টেস্টে উত্তীর্ণ হলে ওই সিলিন্ডার ১০ বছর ব্যবহার করা যায়। আমরা আমাদের প্রতিটি সিলিন্ডার নিয়মিত রি-টেস্ট করি। তারিখ লিখে রাখি। ১০ বছর পর আবারো রি-টেস্ট করি। তবে কোনো সিলিন্ডার গাড়ি থেকে পড়ে বা অন্য কোনো কারনে বাঁকা হলে কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই সিলিন্ডার ১০ বছর আগে রি-টেস্ট করা হয়। রি-টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পারা সিলিন্ডারগুলো আমরা সাথে সাথে চার টুকরো করে কেটে স্ক্র্যাপ বানিয়ে ফেলি। এলপিজি লিমিটেডের সিলিন্ডারে কোনো সমস্যা হওয়ার আশংকা নেই বলে তিনি দাবি করেন।
ইউরোপ থেকে বেশ কিছু সিলিন্ডার আমদানির কথা উল্লেখ করে ফজলুর রহমান বলেন, সিলিন্ডারের মেয়াদকাল সচরাচর ১৫ বছর। কিন্তু ইউরোপীয় ওসব সিলিন্ডার ২৫ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে টিকে আছে। সিলিন্ডারের কোয়ালিটির উপর এর মেয়াদ নির্ভর করে জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমান বলেন, রি-টেস্টে সমস্যা না হলেও সিলিন্ডার ব্যবহার করা যায়।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করাার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার অনেক ঝুঁকিপূর্ণ একটি বস্তু। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে সিএনজি সিলিন্ডার। এলপি গ্যাস থেকে এলএনজি গ্যাসের প্রেসার ২০ গুণ বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলপি গ্যাসের চেয়ে সিএনজি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সিএনজি সিলিন্ডার রি-টেস্টের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ দেশে আইনটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার এলপি গ্যাস সারাক্ষণই আগুনের খুব কাছাকাছিতে থাকে। এতে এই সিলিন্ডারকেও একেবারে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে এসব সিলিন্ডার এক বাসা থেকে বাসায় ঘুরছে। তিনি তথ্য প্রকাশ করে বলেন, গত ১০ বছরে দেশে সংঘটিত নয় শতাধিক ছোট বড় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত দেড় হাজার মানুষ হতাহত হয়েছেন। এই ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে নিম্নমানের সিলিন্ডার প্রস্তুত ও ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি রি-টেস্টের বিষয়ে জোর দিতে হবে। সিলিন্ডারের গায়ে প্রস্তুত ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লিখে রাখতে হবে। তাহলেই বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে বাঁচা যাবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোহাম্মদ আলাউদ্দীন গ্যাস ব্যবহারে সতর্কতার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, অসচেতন থাকায় বেশি সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটছে। সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকা নিম্নমানের হোস পাইপ, রেগুলেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এজন্য সিলিন্ডার ঠিক থাকলেও অনেক সময় অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ সংক্রান্ত ঘটনা দিন দিন আরো আশংকাজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, যতই দিন যাচ্ছে সিলিন্ডারের আয়ু ততই বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে দুর্ঘটনার শংকাও। দেশে ক্রস ফিলিংয়ের মাধ্যমে এলপিজির ব্যবসা চলছে। আবার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মান বজায় রেখে সিলিন্ডার তৈরি করছে না। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের মনিটরিং করতে পারছে না। গ্যাসের অনিরাপদ ব্যবহার ক্রমেই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা। তিনি সিলিন্ডার প্রস্তুতের তারিখ ও মেয়াদকাল উল্লেখ এবং নির্দিষ্ট সময়ে রি-টেস্ট করানোর উপর জোরদার করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমবে বলে উল্লেখ করেন।