শারদীয় দুর্গাপূজার প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে ঢাক ঢোল। পূজার সময় সন্ধ্যা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গণসহ আশেপাশের এলাকা। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বারো মাসের প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ে বাড়িতে ঢাক-ঢোল আর বাঁশির শব্দ এবং ঢুলীদের কোমর দুলানো নাচই হচ্ছে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। প্রাচীনকাল থেকেই এ ঢাক বাদ্যের প্রথা চলে আসছে। এছাড়াও অতীতের জমিদারদের পাইক পেয়াদারা ঢাক পিটিয়ে প্রজাদের মধ্যে জমিদারদের হুকুম জারি কিংবা নিমন্ত্রণ করতেন।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ঢাক, ঢোল, খোল, তবলা। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন আর ঢাক-ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পূজা-পার্বণে এখনো ডাক পড়ে ঢুলীদের। পূজার আরতিতে ঢোলের টাকডুম টাকডুম বোলের এখনো কোনো বিকল্প নেই। বছরের এ সময়টাতে ব্যস্ত সময় পার করেন ঢুলী থেকে শুরু করে ঢোল-ঢোলের কারিগরেরা। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম। এবছর সন্ধ্যার পর আরতি সীমিত আকারে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূজা পরিষদ। তাই হাতে তেমন কাজ নেই তাদের। অন্যান্য পেশার মতো বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামত কাজের সঙ্গে জড়িত মানুষের জীবন-জীবিকায় মন্দ প্রভাব ফেলেছে করোনা মহামারি। প্রায় ৯০ শতাংশ আয় কমে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে তাদের জীবিকা। অনেকের সংসার চলছে ঋণ করে। উপার্জন না থাকায় শঙ্কায় এসব পরিবার। গতকাল বুধবার সরেজমিনে ঘুরে ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত দেখা গেল বেশিরভাগ কারিগরদের। কারিগররা জানান, পূজাতে ঢাক-ঢোলের বাজনা অপরিহার্য। কারণ হিন্দুশাস্ত্রেও এর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তাই ঢাক-ঢোল ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায় না। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা কমে যাচ্ছে। তার উপর এবার করোনার আগ্রাসন বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতে জড়িতদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তাল তরঙ্গের স্বত্বাধিকারী সুশীল দাস বলেন, এখন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের দাপটে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা একেবারে কমে গেছে। শুধু পূজা এলে কদর বাড়ে। সারা বছর কাজই পাওয়া যায় না। এবার তেমন ব্যস্ততা নেই। তাই অনেকে এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
পাথরঘাটার মৃদঙ্গ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী দিলীপ দাস বলেন, বছরে তিন (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ) মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। দুর্গাপূজার জন্য কিছু কাজ করছি। এই কাজ করে এখন সংসার চালানো যায় না। আগের মতো দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা নেই। তিনি জানান, ঢোলের মতো দেখতে ‘জোরখাই’ ও ঢাক একজোড়া বিক্রি হয় ১২ হাজার টাকা, ভালো মানের তবলা পাওয়া যায় ৫ হাজার টাকায়। এ বছর বিক্রি তুলনামূলক অনেক কম।
পাথরঘাটা এলাকায় বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামত কাজের সাথে জড়িত মানিক চন্দ্র দাস (৪৬) বলেন, পৈতৃকসূত্রে এ পেশার সাথে জড়িত। অন্য কোন কাজ জানি না। করোনা মহামারি আমাদের আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না হলে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও হয় না, তাই বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের প্রয়োজনও হয় না। তিনি বলেন, কোনো আয়-উপার্জন নেই, জানি না এভাবে আর কতদিন চলবে। এখন ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। তিনি বলেন, করোনা মহামারির আগে তিনি প্রতিদিন গড়ে ১৫০০ টাকা আয় করতেন আর এখন আয় আসে মাত্র ১২০-১৫০ টাকা যা দিয়ে সংসার চলে না।
কারিগররা জানান, ঢোল তৈরিতে কারিগরেরা কাঁচামাল হিসেবে দেশীয় আম, জাম, রেইনট্রি, কড়াই ও মেহগনি কাঠ ব্যবহার করেন। আর ঢাকের ছাউনির জন্য ছাগল ও ভেড়ার চামড়া এবং বেড়ি দেওয়ার জন্য মহিষের চামড়া ব্যবহার করে থাকেন। এখন এসব কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো আর ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রগুলোর কদর না থাকায় কমে গেছে তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম।