১৯৮০ বা ১৯৮১ সাল। আমার শৈশব। প্রকৃতির অকৃত্রিম আদরে অবলীলায় নিজ গ্রামেই বেড়ে ওঠা। বাবা শিক্ষক – শহরে থাকতেন, এখন প্রয়াত। তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রোববার। প্রতি শনিবারে বাড়ি আসতেন। বাবার ব্যাগে আর কিছু থাক বা না থাক একটা পত্রিকা থাকত (শনিবারের)। একবার শনিবারে বাবা বাড়ি ফিরে রিফ্রেশমেন্টশেষে ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছেন, আজাদী পত্রিকা। বিষয়টা নতুন নয়, তবে সেদিন কেন যেন মনের শৈশবীয় চঞ্চলতা এড়িয়ে বিষয়টা বিশেষ ভাবে নজরে এল। সেইদিনই আমি জীবনে প্রথমবার ‘আজাদী’ শব্দটির দিকে বিশেষ নজর দিলাম আর ভালভাবে পরিচিত হলাম ‘দৈনিক আজাদী’ নামের এই পত্রিকার সাথে। সেদিন যদি বুঝতাম একদিন বিষয়টি এত আনন্দ আর গর্বের সাথে আমার হৃদয়ে আন্দোলিত হবে তবে তারিখটা ঠিক স্মৃতিতে ধরে রাখতাম। শৈশবে আমার মনে তখনও এতটা স্থিরতা আসেনি যে পত্রিকার প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণ বোধ থাকবে। সহজ কথায় পত্রিকা পড়া বা বোঝার কোন উপলব্ধি তখনও সৃষ্টি না হলেও পত্রিকার ছবিগুলো দেখার একটা আকর্ষণ ঠিকই ছিল। যাহোক বাবা শহরে চলে গেলে পত্রিকাটা খেলার ছলে প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতাম। এভাবে আস্তে আস্তে আজাদী পত্রিকার সাথে সম্পর্ক শুরু হতে লাগল। দিন গড়িয়ে যখন আমি অষ্টম/নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকে আস্তে আস্তে পত্রিকার টুকিটাকি খবর, গল্প, নাটক বা অন্যান্য ফিচার পড়ার দিকে ঝোঁক সৃষ্টি হতে লাগলো আর তা ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হল। এরপর থেকে আমার অনুরোধে বাবার সারা সপ্তাহে নিজের পড়া শেষে জমানো দৈনিক আজাদী পত্রিকা শহর থেকে নিয়ে আসতেন আর আমি পরের সপ্তাহে বাবা না আসা পর্যন্ত এগুলো আমার দৈনন্দিন পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে দেখতাম ও পড়তাম। এভাবে আজাদীর প্রতি আমার সখ্যতার যোগসূত্র ঘনীভূত হতে লাগল। পরবর্তীকালে কলেজ জীবনে দৈনিক পত্রিকা যখন হাতের নাগালে তখন থেকেই তাজা পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে, অবশ্যই সেটা দৈনিক আজাদী। ধীরে ধীরে এ পত্রিকা কখন যে নিজের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে তা একটুও টের পাইনি। জীবনের পথে সুদীর্ঘকাল ধরে ‘দৈনিক আজাদী’ চলার সাথী হয়ে উঠেছে, এছাড়া যেন মোটেই চলে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার পর যা পেতে চাই তা হলো চা-বিস্কুটের সাথে দিনের ‘দৈনিক আজাদী’। এক নজর দেখেই তারপর অন্য সব ব্যস্ততার প্রস্তুতি। এভাবেই দিনে দিনে হয়ে উঠে ‘আজাদী আমার’।
এ যে আজাদী ‘আমার’ হয়ে ওঠা – তা আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বদরবারে বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ‘আমার আজাদী’ হিসেবে সমাদৃত। আজাদীর এ মর্যাদার অগ্রযাত্রার ধারক ও বাহক হয়ে যিনি নিরলস শ্রমে আজাদীকে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন তিনি আজাদীর কর্ণধার লায়ন (সাবেক জেলা গভর্নর) এম এ মালেক। সৌম্য ও বিনয়ী রসবোধে পরিপূর্ণ সহজ সরল প্্রকৃতির সাদামাটা মানুষটি অত্যন্ত উদার ও বহুগুণে গুণান্বিত। পারিবারিক ঐতিহ্য ও স্বীয় উন্নত ব্যক্তিত্বের মহিমায় চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশে আজাদীর মালেক সাহেব নামে তিনি পরিচিত। তাঁর পিতা এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম মেকাানিক্্যাল ইঞ্জিনিয়ার মরহুম আবদুল খালেক মারা যাওয়ার মাত্র দু’বছর পূর্বে ১৯৬০ সালে ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘দৈনিক আজাদী’। সেই থেকে বিরামহীন পথ চলার ৬০ বছর পূর্ণতা পেল সগৌরবে। যতই দিন এগিয়েছে, ততই আজাদীর প্রতি মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। এ চলার পথ যে একেবারে সুগম ছিল, তা নয়। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তাকে লালন ও ধারণ করে দুর্গম পথ পেরিয়ে আজকের সফল আজাদী। জন্মের পরপরই যুদ্ধের ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধকালীন সময়েই ‘দৈনিক আজাদী’র দেশের পক্ষে প্রগতিশীল অবস্থানের কথা ইতিহাস সাক্ষী দেয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে অপরিসীম শক্তি ও অসীম সাহসের সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় নিঃসংকোচে- নির্ভয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে দেশের কল্যাণকামিতায় নিয়োজিত থেকেছে। সহস্র সংকটেও আজাদী কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করেনি। একটি বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষায় সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত থেকে এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিত্য সেবা দিয়ে গেছে আজাদী যা আজও চলমান। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মাঝেও মানুষের নির্ভরতা ও আস্থা অর্জনের ধারাবাহিকতায় একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানের গৌরবের ৬০ বসন্ত পার করে দেওয়া সহজ কথা নয়। প্রতিটি বসন্তে আজাদী মানুষের হৃদয়কে দ্ব্যর্থহীনভাবে নতুন মাত্রায় স্পর্শ করতে পেরেছে। আজাদীর মেধাবী, সুদক্ষ ও আদর্শ কুশলীদের নিরলস শ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ধারাবাহিক সম্পৃক্ততায় এ গৌরবের সৌরভ চারিদিকে বহুমাত্রায় ছড়িয়েছে বলে একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে আমার ধারণা। অনেকে যারা এর নেপথ্যে রয়েছেন তাঁরা আজাদীর এক একটি মঙ্গল প্রদীপ। বর্তমানে আজাদী একটি স্বচ্ছ ও সবল দৈনিক। বহু উপকরণের পরিচ্ছন্ন সজ্জায় একটি সম্ভ্রান্ত পত্রিকা। আজাদীর এ সংগ্রামমুখর গৌরবময় যাত্রা পরবর্তী মাইল ফলক ছোঁয়ার অপেক্ষায়।
নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, সময়ের আলোচিত কলাম, চলমান ঘটনাপঞ্জীর ভদ্রোচিত ব্যাখ্যা, অভিজ্ঞতার আলোকে সম্পাদনা এবং কৃতিত্বমূলক মন্তব্য লেখায় সমৃদ্ধ পত্রিকার চাহিদা থাকবেই। এটাই আজাদীর মূল বৈশিষ্ট্য বলে একজন পাঠক হিসেবে আমার বিশ্লেষণ। তাছাড়াও রাজনীতি, শিক্ষা-চিকিৎসা-জীবনধর্মী সমসাময়িক প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়া, কৌতুক ইত্যাদিও ধারাবাহিক বিন্যাস পাঠকের চাহিদা মিটিয়ে হৃদয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করে নিয়েছে আজাদী সমহিমায়। অনেক গুণী লেখকের লেখনীর ছোঁয়ায় আজাদী সমৃদ্ধ হয়েছে সেকথা যেমন সত্যি তেমনি আজাদী সুদীর্ঘকালে চলার পথে অগণিত গুণী লেখকের জন্মও দিয়েছে। আজাদী পাঠক সৃষ্টিতে যেমন চৌকষ, তেমনি লেখক সৃষ্টিতেও আজাদীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। নতুন লেখকের মেধার সৃজনশীলতায় মান উন্নয়নে আজাদী বরাবরই যত্নশীল। বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন পেশার মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত ও বিকশিত করার লক্ষ্যে তাদের লেখনী- কবিতা, ফিচার, গল্প, উপন্যাস, ছড়া ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশ করে তাদের লেখনীতে উৎসাহ দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। আজাদীর গুণী লেখকদের প্রতি অন্য সবার মত আমারও নজর কারে। ভক্ত পাঠকের সারিতে থেকে প্রতিভাবান লেখকদের লেখা পড়তে পড়তে নিজের অজান্তে লেখনীর সৃজনশীলতা আমাকে নাড়া দেয় আর নিজের মত নিবন্ধ ও কবিতা লেখা শুরু করি। কৃতজ্ঞতার সাথে বলতে হয় তার কিছু কিছু পত্রিকায় প্রকাশ করায় অনুপ্রাণিত হই। সত্যিকার অর্থে লিখনীর জগতে আমি আজাদীর আশীর্বাদসিক্ত বটে। সৃজনশীল জগতে আজাদী আমায় নতুন মাত্রায় জন্ম দিয়েছে। এভাবে দিনের শেষে দেখি আমি আজাদী পরিবারের একজন ‘আমি আজাদীর’।
বর্তমানে সংবাদপত্র দু’ধারার টানপোড়নে ভুগছে- এনালগ ও ডিজিটাল। এতদ্সত্ত্বেও আজাদীর পাঠকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। লাভ লোকসানের হিসাবকে পেছনে ফেলে রেখে পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে থেকে মানুষের আস্থা আর ভালবাসার জায়গাটা প্রবলভাবে যতনে লালন করে চলেছে আজাদী। আশারাখি আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আর আমরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করবো ‘আমি আজাদীর, আজাদী আমার’।
লেখক : ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড