সারা দেশে ক্ষোভ, ধিক্কার

প্রধান আসামিসহ গ্রেপ্তার ৪, ভিডিও অপসারণের নির্দেশ ।। বিবস্ত্র করে গৃহবধূকে নির্যাতন

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ৬ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ধিক্কার জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। এদিকে এই ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে দুইজনকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। আর দুইজনকে নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে গত রোববার রাতে নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন। সেখানে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৭-৮ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন- বাদল, মো. রহিম, আবুল কালাম, ইস্রাফিল হোসেন, সাজু, সামছুদ্দিন সুমন, আবদুর রব, আরিফ ও রহমত উল্যা। তাদের সবার বাড়ি বেগমগঞ্জে। আসামিদের মধ্যে রহিম ও রহমত উল্লাকে নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন। আর র‌্যাব-১১ এর একটি দল গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে প্রধান আসামি বাদলকে এবং নারায়ণগঞ্জে থেকে ওই চক্রের দলনেতা দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ। এদের মধ্যে দেলোয়ারের নাম মামলার এজাহারে নেই, তবে সেও ওই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার কাছে একটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন আশিক বিল্লাহ।
পরে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনকারী সবাই দেলোয়ার বাহিনীর লোক। তারা বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি ও কু-প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছে বলেও জানায় র‌্যাব।
র‌্যাব জানায়, ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ৩৫ বছর বয়সী ওই গৃহবধূর বাড়িতে ঢুকে একদল যুবক বিবস্ত্র করে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালায় এবং তার ভিডিও ধারণ করে। একমাস পর ৪ অক্টোবর ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আসামিরা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। রোরবার রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইলে চেকপোস্টে বাসে তল্লাশি চালানোর সময় বেগমগঞ্জের ‘দেলোয়ার বাহিনী প্রধান’ দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার সঙ্গে থাকা দুই রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। পরে ভোরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কামরাঙ্গীরর চর এলাকায় একটি প্লাস্টিক কারখানা থেকে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ওরফে বাদলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, দেলোয়ার এলাকায় অস্ত্রধারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বাহিনী ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সাইফুল বলেন, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। তবে ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পেছনে কাদের হাত রয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শ্লীলতাহানি ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা এই কাজ করেছে। তবে পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে ৮/১০ জন জড়িত রয়েছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওই মামলায় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেনের নাম না থাকলেও তিনি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। আসামিরা সকলেই দেলোয়ার হোসেনের লোক।
ভিডিও অপসারণের নির্দেশ : গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। পাশাপাশি বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে ভিডিওটি পেনড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে ওই নারীর নিরাপত্তা, জবানবন্দি নেওয়া, দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কি না তা অনুসন্ধানে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে হাই কোর্ট। কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা ও চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া আদালত এ ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে আগামী ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে। ২৯ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশে একের পর এক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং এসব ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পদত্যাগ দাবিতে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে অবস্থান নেন বিক্ষুব্ধরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও লেখক, শিল্পী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, নারী অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ গিয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি জানান। বিকালে শাহবাগ থেকে লাঠি মিছিল বের করে এদিনের মতো সেখানে কর্মসূচি শেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন। আজ মঙ্গলবারও শাহবাগে অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অনীক রায় বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) সকাল ১১টায় শাহবাগে আবারও আমরা গণজমায়েত করে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পৃথক মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে।
কুপ্রস্তাবে রজি না হওয়ায় ভিডিও ফাঁস : মামলার বরাত দিয়ে বেগমগঞ্জ থানান ওসি হারুনুর রশীদ বলেন, দাম্পত্য কলহের জেরে ওই নারী একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তার বাবার বাড়িতে থাকতেন। দীর্ঘদিন পর গত ২ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে দেখা করতে সেখানে যান তার স্বামী। সেদিন রাত ৯টার দিকে আসামিরা তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে এবং ওই নারীর স্বামীকে মারধর করে পাশের আরেকটি ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তারা ওই নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তাতে বাধা দিলে আসামিরা তাকে নির্যাতন করে এবং মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ভিডিও করতে থাকে। ওই নারীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা কাউকে কিছু জানালে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়। এরপর ওই নারী কাউকে কিছু না জানিয়ে জেলা শহরের মাইজদীতে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও আসামিরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ‘কুপ্রস্তাব’ দেয়। রাজি না হলে সেই রাতের ভিডিও তারা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নারী তাদের কথায় রাজি না হওয়ায় আসামিরা একমাস পর গত রোববার দুপুরে ওই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে বোনের বাসা থেকে ওই নারীকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় বলে জানান ওসি। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক একজন নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করছে। তাদের একজন পা দিয়ে ওই নারীর মুখ চেপে ধরেছে। বারবার আকুতি জানানোর পরও নির্যাতন করা বন্ধ করেনি তারা। ওই নারীর বাবা সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ‘প্রভাবশালী হওয়ায়’ এতদিন ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস হয়নি তাদের। এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, মামলার বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ফুটবলারদের জন্য দারুণ সুযোগ