ধর্ষণের ঘটনা ঘটতেই আছে, যা লাগামহীন। যাতে কেবল নারীর জীবনযাপন বিপন্ন হচ্ছে, তা নয়; সামগ্রিক নিরাপত্তাবলয় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা হয় বেপরোয়া, নয়তো রাজনৈতিক শক্তির আশ্রয়ভুক্ত। ক্ষমতার ছায়া ছাড়া এহেন অপকর্ম করা ও বিচারের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। যত্রতত্র ঘটা ধর্ষণের পরিসংখ্যানই তা বলে। আর এসব ঘটনার প্রতিবাদে ব্যানার পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে বিচার চায় সাধারণ জনগণ। কিন্তু আমাদের দেশে মিটিং মিছিলকে সর্বদাই ক্ষমতাসীনদের বিরোধী হিসেবে দেখা হয়, যা অতীতকাল থেকেই প্রচলিত প্রথা হিসেবে চলছে। অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই নানা রকম নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হতে হয় আন্দোলনকারীদের। যার কারণে শুধু ধর্ষণ নয়, অসংখ্য অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক সচেতনতামূলক সভা সেমিনার করেও কমানো যাচ্ছে না। এমনকি আইন করেও সুফল আসছে না। ফলে বাড়ছে ধর্ষণ নামক অসামাজিক কার্যকলাপ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের বিচার দৃশ্যমান না হওয়ার কারণে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা কমছে না। আইনজীবী সালমা আলীর মতে, আমাদের দেশে যৌননিপীড়ন ও ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কঠিন আইন আছে, বিভিন্ন নীতিমালাও আছে। কিন্তু একটা বড় সমস্যা হলো সবসময়ই শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় সবখানে কিছু গ্রুপ থাকে যারা মনে করে, তারা আইন-আদালত সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ক্ষমতার দাপট তাদের অন্ধ করে ফেলে। এদের আমরা বলি ‘পাওয়ার রেপিস্ট’। তারা মনে করতে থাকে যেকোনো অপরাধ করলেও তারা পার পেয়ে যাবে। তাই কোনো ঘটনা ঘটাবার আগে তারা কোনোকিছুই তোয়াক্কা করে না। সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজে আমরা যে জঘন্য দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা দেখলাম, সেটা এমন ‘পাওয়ার রেপিস্ট’ মানসিকতারই ফল। দেশে এখন এমন পাওয়ার রেপিস্টদের রাজত্ব চলছে। আর খাগড়াছড়িতে যে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটল সেটাও কিন্তু একই রকমের বিষয়। সেখানে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইন দিয়ে বিচার করা অপরাধ কমিয়ে আনার একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু সবসময় কেবল আইন করে আর সাজা দিয়ে অপরাধ কমানো যায় না। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে ধর্ষণ বা কোনো অপরাধ কেন হয় তার কারণ অনুসন্ধান করা। আমরা কিন্তু এ বিষয়ে খুব একটা কাজ করছি না। যারা সমাজ-গবেষণায় যুক্ত, যারা পেনাল কোড রিফর্ম বা আইন-সংস্কার নিয়ে কাজ করি, যারা মনো-সামাজিক বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করি, যারা যুবকদের নিয়ে বা তরুণসমাজ নিয়ে কাজ করি তাদের সবারই এই দায়িত্ব রয়েছে। কারণ ধর্ষণ কেবল যৌনবিকৃতি বা যৌনসুখের বিষয় নয়; এর সঙ্গে সমাজে বিদ্যমান নানা রকম সমস্যা ও সংকট এবং ক্ষমতার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। এজন্যই এ ধরনের বিষয় নিয়ে আমাদের অনেক রকম সামাজিক সমীক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
খুব কঠিন পরিস্থিতি এখন। একদিকে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্ষকের বিচার হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ এখনো নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা ও উপস্থাপন করার স্তরেই রয়ে গেছে। পারিবারিক সহিংসতা ও পরিবারে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিবেচনা করলেও এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ফলে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কাজটা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে হবে। সুস্থ সমাজের জন্য সুস্থ মানসিকতা দরকার।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, দেশে সামাজিক অবক্ষয় আজ চরম আকার ধারণ করেছে। এ কারণেই ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ধর্ষণ তথা সমস্ত সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। অবিলম্বে ধর্ষণ বন্ধ করার সকল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিচার দেরিতে হওয়ার কারণে অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়। যারা এসব অপরাধ করছে তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে চরম শাস্তি দিতে হবে।