প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

| বুধবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৪:২৫ পূর্বাহ্ণ

খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.)’র প্রতি শ্রদ্ধায় ফিরোজ শাহ তুগলক

হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.)। তিনি সুলতানুল মাশায়েখ, মাহবুবইলাহী লকবে ভূষিত। ভারতবর্ষ পেরিয়ে বিশ্বে তিনি অতি পরিচিত আলোচিত মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামকরণে ঐ এলাকার নাম নেজাম উদ্দীন। ঐ রেল স্টেশনের নামও হযরত নেজাম উদ্দীন। বিশ্বের তাবলীগ মারকাজ তাঁর মাজারে যাওয়ার পথে আগে দিল্লি জামে মসজিদ কেন্দ্রিক মুসলমানগণের জংশন হলেও একালে গিঞ্জি পরিবেশ। মুসলমানগণের জংশন এখন নেজাম উদ্দীন; যেমনি জেয়ারতকারী তেমনি তাবলীগ। ফলে মুসলমানগণের অত্যধিক আনাগোনায় সমৃদ্ধি লাভ করে নেজাম উদ্দীন এলাকা।

তাঁর ইন্তেকালের সময় সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক ১৬ বছরের যুবক। এতে তিনি সুলতানী পদে না পৌঁছলেও তাঁর সংস্পর্শ পেয়েছেন বলা যাবে। জীবদ্দশায় হযরত খাজা নেজাম উদ্দীনের উপর ধারণা থাকবে স্বাভাবিক। ফিরোজ শাহ তুগলক ৪২ বছর বয়সে দিল্লির মসনদ প্রাপ্ত হন। দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় তিনি হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.)’র প্রতি সম্মান জানাতে মন থেকে তাড়িত হন।

হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন ইন্তেকাল করে গেছেন অনেক বছর। তাঁর সাদামাটা কবর উন্মুক্ত স্থানে। কিন্তু সুলতান এ কবরের উপর বহু অর্থ ব্যয়ে মাজার নির্মাণ করেন। দরজা নির্মাণ করেন চন্দন কাঠের। সোনার শিকল, সোনার বাতিদান ও ঝাড় লাগিয়ে দেন সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য; যেগুলো গম্বুজের চার ধারে ঝুলন্ত। তিনি এ মাজার কমপ্লেঙের জন্য জমিও দান করেন।

বস্তুতঃ সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও শান্তি প্রিয়। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ রক্তপাত অপছন্দ করতেন। ক্ষমতা লাভ করে প্রথমে দিল্লির সুফি দরবেশের জেয়ারতে আসক্ত হন।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় তাঁর অগ্রজ সুলতান ইলতুতমিস ছিলেন ধর্মের দিক দিয়ে ফিরোজ শাহ তুগলকের সাথে অনেকটা মিল। কিন্তু সাম্রাজ্য শাসনে তিনি ছিলেন কঠোর। কঠোর হস্তে বিশাল ভারত তথা তাঁর সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন, রেখে ছিলেন হাতের মুঠোয়। আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, সুলতান ইলতুতমিসের ধর্মীয় মুরব্বি ছিলেন হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.)। হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ মঈন উদ্দীন চিশতি আজমীরি (রহ.) দিল্লি থেকে আজমীর চলে যাচ্ছেন। সাথে তাঁর মহান শীর্ষ হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুলতানের অনুরোধে দিল্লিতে রেখে যান। হযরত খাজা কাকী ইন্তেকালের পূর্বে একটি অছিয়ত নামা রেখে যান। ইন্তেকালের পর জানাজায় অসংখ্য লোকের সমাগম হবে স্বাভাবিক। এতে সুলতান ইলতুতমিসও ছিলেন। যখন খাজা কাকীর রেখে যাওয়া অছিয়ত নামা পড়া হচ্ছিল। অছিয়ত নামাটি নিম্নরূপ:“ আমার জানাজার নামাজ তিনিই পড়াবেন, যিনি কখনও হারাম কর্ম করেননি এবং যিনি আসরের নামাজের সুন্নত কিংবা তকবীরউলা ত্যাগ করেননি।” অছিয়ত নামার অর্থ মানতে পারা মহান ব্যক্তি সুলতান ইলতুতমিস বাধ্য হয়ে তিনি জানাজা পড়ান।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক বাংলায় দুইবার অভিযানে আসেন। কিন্তু দু’বারই রক্তপাত না ঘটায়ে ফিরে যান। একবার ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বিদ্রোহ দমন করতে আসেন। অবরোধ করেন মালদাহের একডালা দুর্গ। তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, অসামরিক তথা সাধারণ নাগরিকের কোন লুণ্ঠন বা ক্ষতি করা যাবে না। নারীদের উপর অত্যাচার করা যাবে না। এমন কি তাদের ধরা বা বন্দী করাও যাবে না।

ইতিপূর্বে দিল্লির কোন সুলতান ঐ প্রকার শুভ ও সংযত নির্দেশ দেয়নি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে বহু সৈন্য নিহত হলে তিনি তাদের মৃত দেহ দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “এ গরীব মানুষেরা মারা গিয়েছে যেহেতু তারা তাদের নিজেদের ও পরিবারের জন্য জীবিকা উপার্জনের একটি উপায় হিসেবে নিয়ে ছিলেন।”

শুধু তাই নয়, একঢালা দুর্গের উপর থেকে যখন নারীরা সুলতানের উদ্দেশ্যে কাতর আবেদন জানাচ্ছিলেন তাদের সাহায্যের জন্য তখন সুলতান বলেছিলেন,“ আমি যদি আমার সৈন্যদের এ অসহায় নারীদের নির্দেশ দেই, তাহলে আমার সাথে মুঘলদের কি পার্থক্য থাকবে?”

এ প্রকার উদারতা, যুক্তিপূর্ণ ব্যবহার ও নির্দেশ তৎকালে অভাবনীয় ছিল। সুলতান ফিরোজ শাহ যে মানবিক গুণে এত উচুস্তরে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন তা অবশ্য স্বীকার্য। তিনি ছিলেন উদার মন মানসিকতার ব্যক্তিত্ব। ছিলেন ধর্মপালনে নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। তিনি বিদ্রোহ দমনের জন্য সচেষ্ট থাকতেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলককে দ্বিতীয় ওমরের সাদৃশ্য বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি খাটি গুড়া সুন্নি মতাবলম্বী। দীর্ঘ ৩৭ বছর রাজত্বকালে দেশে শান্তি, সমৃদ্ধি বজায় ছিল। তিনি সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। যদিওবা তাঁর দরবার ছিল অতি আকর্ষণীয় ঝাঁকজমকপূর্ণ। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে তুগলক বংশের পতন শুরু হয় বলা যাবে।

অপরদিকে হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.) ছিলেন বিশ্বখ্যাত মহান দরবেশ। তাঁর পীর ছিলেন বৃহত্তর লাহোরে শায়িত হযরত ফরিদ উদ্দীন গঞ্জে শখর। তাঁর পীর হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.)। হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.)’র সেই সময়ও মুরিদ ছিল লক্ষ লক্ষ। ৬ শতের অধিক খলিফা ছিলো তাঁর।

অর্থাৎ ভারতবর্ষে সুফিজমের ইতিহাসে তাঁর বিশালত্ব ভাববার বিষয়। আমাদের বাংলায়ও তাঁর একজন মহান খলিফা শায়িত। তিনি হলেন মালদায় তথা গৌড় পান্ডুয়ার মধ্যখানে হযরত আখি সিরাজ উদ্দীন (রহ.)। তাঁকে আয়নায়ে হিন্দও বলা হয়।

বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড় ও পান্ডুয়া। এ পান্ডুয়াতে শায়িত হযরত আখি সিরাজ উদ্দীন (রহ.)’র অন্যতম খলিফা হযরত শেখ আলাউল হক (রহ.)। তিনি ছিলেন সম্পদশালী এবং মহান ওলি। তাঁর এক পুত্র মহান ওলি নূর কুতুবুল আলম। তাকে নিয়ে ভারতবর্ষে অনেক লেখালেখি আছে। তাঁর অপর ভ্রাতা পিতার সম্পদে বলীয়ান থাকলেও নূর কুতুবুল আলম অতি সাদামাটা জীবন যাপন করে গেছেন। তাঁর পীর ভাই তথা পিতা আলাউল হক (রহ.)’র আরেক মহান খলিফা হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানী। ইরানের সেমনান প্রদেশের বাসিন্দা বিধায় সেমনানী। উত্তর প্রদেশের কছৌছাতে শায়িত বিশাল মাজার কমপ্লেঙ নিয়ে। তাঁর বংশধররা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় তরীকতে থেকে শরীয়তের বিশাল খেদমত করে যাচ্ছেন। যেমন মালদায়, পান্ডুয়াতে বৃহদাকারের মাদ্‌রাসা কমপ্লেঙ পরিচালনা করতেছেন।

বাদশাহ আওরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারতের আহমদনগরে ইন্তেকাল করেন। অছিয়ত মতে তাঁর লাশ (মৃতদেহ) আহমদ নগর থেকে ঔরাঙ্গবাদে নিয়ে আসা হয়। ঔরাঙ্গবাদের নিকটবর্তী হুলদাবাদে শায়িত আছেন হযরত নেজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ.)’র অন্যতম খলিফা বোরহান উদ্দীন ও তাঁর খলিফা জৈন উদ্দীন (রহ.)। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আগ্রহে তাঁর লাশ এখানে এনে শায়িত করা হয়।

হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.) ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর কবরের পাশে শায়িত প্রখ্যাত সুফি, কবি আমির খসরু, নাসির উদ্দীন ছেরাগ দেহলভী (রহ.) সহ অনেক বিশ্বখ্যাত ওলি দরবেশ রয়েছে। দিল্লির সুলতান তাঁকে দরবারে পেতে আগ্রহী থাকত। কিন্তু তা পরিহার করে তাঁর অন্যতম শীর্ষ সুফি ও কবি আমির খসরু কে রাজ দরবারে পাঠাতেন। একবার অনন্য উপায় হয়ে তাঁকে রাজ দরবারে যেতে হয়। হযরত খাজার কথায় উপস্থাপনে সুলতান লজ্জিত হয়। বর্ণনা মতে হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.) একবারই দরবারে গেছেন বলে জানা যায়। সে এক দীর্ঘ বর্ণনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামলেখক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকীর্তির মাঝেই চিরজীবী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
পরবর্তী নিবন্ধআর্মেনিয়া আজারবাইজান সংঘাতে নিহত বেড়ে ৯৫