আইসিটি (তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি) খাতে দক্ষ জনশক্তি ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নগরে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’। কালুরঘাট বিএফআইডিসি রোড সংলগ্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দুই একর জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ’। এতে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, বিএফআইডিসি রোডে সিটি কর্পোরেশনের ১১ দশমিক ৫৫১ জায়গা রয়েছে। পুরো জায়গায় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ হাইটেক পার্ক গড়ে তোলা হবে। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ সিটি কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। চুক্তির আওতাভুক্ত জায়গার মধ্যেই শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি এ সেন্টার নির্মাণে সিটি কর্পোরেশন থেকে দুই একর জায়গা বুঝে নেয় হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ হাইটেক পার্ক গড়ে উঠলে প্রযুক্তি খাতে গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে চট্টগ্রামের। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্ট ও আইসিটি পণ্য উদ্ভাবন এবং তা বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। সর্বোপরি সরকারের রপ্তানি আয় সংক্রান্ত অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে চট্টগ্রাম।
শুরু হয়েছে প্রাথমিক কাজ : ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ নির্মাণ প্রকল্পের উপ–পরিচালক আবু রাফা মো. আরিফ দৈনিক আজাদীকে বলেন, হাইটেক পার্কের জন্য ১১ একরের বেশি জায়গা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই একর জায়গায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। ইতোমধ্যে আমরা ঠিকাদার নিয়োগ করেছি। তারা পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে। ধীরে ধীরে সেখানে কাজ দৃশ্যমান হবে।
গতকাল বিকেলে বিএফআইডিসি রোডস্থ সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় সরেজমিন উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় পাশাপাশি দুটো সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। একটিতে লেখা আছে, ‘চট্টগ্রাম জেলার আইটি/হাইটেক পার্কের নির্ধারিত স্থান’। অপর সাইনবোর্ডটি ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। দুটি সাইনবোর্ডেই সম্ভাব্য হাইটেক পার্ক ও আইটি সেন্টারের ছবি রয়েছে।
দেখা গেছে, জায়গাটির বেশিরভাগই জলাশয়। এর এক পাশে সাত–আটজন শ্রমিক সীমানা দেয়াল নির্মাণে কাজ করছেন। এজন্য ইত্যেমধ্যে বেশ কিছু লোহার খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দশদিন আগে সেখানে কাজ শুরু হয়। সীমানা দেয়াল নির্মাণ শেষে জলাশয় ভরাটসহ অন্যান্য কাজ শুরু হবে।
পাঁচ বছর প্রতীক্ষার অবসান : ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ৫২২ কোটি ৫৪ লাখ ৯২ হাজার টাকায় অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় ৮টি জেলা তথা চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাহ, নাটোর, বরিশাল, মাগুরা, নেত্রকোণা ও রংপুর জেলায় সেন্টারটি নির্মাণ করা হবে।
এদিকে ২০১৭ সালে চট্টগ্রামসহ দেশের ১২ জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণে এক হাজার ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকায় আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। অন্য জেলাগুলো হচ্ছে– ময়মনসিংহ, জামালপুর, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, কঙবাজারে, রংপুর, নাটোর, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা।
২০১৭ সালে প্রকল্প অনুমোদন হলেও জায়গার অভাবে চট্টগ্রামে হাইটেক পার্ক এবং আইটি ট্রেনিং ও কিউবেশন সেন্টার নির্মাণ শুরু করা যাচ্ছিল না। যদিও ইতোমেধ্যে রাজশাহী ও নাটোরে আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।
২০১৮ সালের ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই সিঙ্গাপুর–ব্যাংকক মার্কেটে ‘সফ্টওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ নির্মাণে সিটি কর্পোরেশন ও হাইটেক পার্ক কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন কালুরঘাটে চসিকের ভূমিতে হাইটেক পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব দেন। অনুষ্ঠান শেষে মেয়র ও হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগমকে জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরদিন দাপ্তরিক চিঠি দিয়ে চসিকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জায়গা চান হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালুরঘাটের জায়গাটি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সীতাকুণ্ড জঙ্গল সলিমপুরে তিনটি জায়গা পরিদর্শন করেন। পরে তিনি চসিকের জায়গাটি বাছাই করেন এবং একইবছরের ১১ মার্চ উভয় সংস্থার মধ্যে সমাঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
অবশ্য ২০১৫ সালে নগরের বাকলিয়ায় ৯৮ একর জায়গার ওপর দেশের প্রথম সাইবার সিটি গড়ার পরিকল্পনা ছিল মন্ত্রণালয়ের। এরপর ২০১৬ সালে ২০০ কোটি টাকায় বাকলিয়ায় হাইটেক পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে বাছাইকৃত জায়গা বিরোধপূর্ণ হওয়ায় প্রকল্পটি আটকে যায়। এখন কালুরঘাটে প্রকল্পের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হলো।
জায়গার সংকট দূর হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ স্থাপনে দরপত্র আহবান করে। ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় ‘হোসেন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড’কে পার্কটি নির্মাণে চূড়ান্ত করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
যেমন হবে সেন্টারটি : সেন্টারটি হবে ৬ তলা ভবনের। যা সাড়ে ৩৫ হাজার বর্গফুটের। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এসএসসি ও এইএসসি পর্যায়ে ছাত্র–ছাত্রীদের আইটিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করা, একাডেমিয়া বা আইটি ইন্ড্রাস্ট্রির মধ্যে সেতু বন্ধন এবং আইটি/আইটিইএস সর্ম্পকিত খাকে দেশের যুব সমাজের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
চুক্তির খসড়া থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইটেক পার্ক নির্মাণে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করবে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। তিন বছরের মধ্যে শেষ হবে নির্মাণ কাজ। লাভ্যংশ চসিক ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ৫০ শতাংশ করে পাবে।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ‘হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে হাইটেক শিল্পে দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের প্রসার ও বিকাশে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এছাড়া হাইটেক পার্ক নিয়ে দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতোমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে। স্বল্প খরচে জায়গা, নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা এবং উন্নত যাতায়াত সুবিধা থাকাসহ বিভিন্ন কারণেই এসব পার্কের প্রতি সবার আগ্রহ বাড়ছে।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে হাই–টেক শিল্পে দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে। যার সুফল পাবে চট্টগ্রামবাসী। একইসাথে প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের প্রসার ও বিকাশে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে।