বিকৃত আনন্দ পেতেই দুর্বৃত্তরা বাইরে থেকে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে। অন্য যানবাহনের তুলনায় ট্রেনে দুর্ঘটনা অনেক কম। ট্রেন যাত্রা তারপরও সব সময় নিরাপদ নয়। ট্রেনের যাত্রীদের জন্য এক আতঙ্ক ‘পাথর নিক্ষেপ’। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরে নিহত হচ্ছেন যাত্রীরা। আর আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমনকি অনেক যাত্রীর অঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটেছে। পাথর নিক্ষেপ করা দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন দিন বেড়েছে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। গত বছর রেল মন্ত্রণালয় থেকে একটা হিসাব প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, শুধু পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় গত পাঁচ বছরে ট্রেনের ২ হাজারের বেশি জানালা–দরজা ভেঙেছে। পাথরের আঘাতে দরজা–জানালার ভাঙা কাঁচসহ অন্যান্য সামগ্রী মেরামত করতে রেলওয়ের বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বছরে অন্তঃত দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। রেল পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনামূলক লিফলেট বিতরণ, মাইকে প্রচার করাসহ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কাজ করলেও সহসাই রোধ করা যাচ্ছে না ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। ফলে রেলপথ অনিরাপদই থেকে যাচ্ছে। বিগত দিনে চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে রেলকর্মীদেরও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর শনিবার মহানগর গোধূলি নামে ট্রেনটিতে চলন্ত অবস্থায় পাথর নিক্ষেপ করলে জানালার কাঁচ ভেঙে এক মহিলা মারাত্মকভাবে জখম হন। এর আগে গত ৭ জানুয়ারি সুবর্ণ এঙপ্রেসের ট্রেনটি বিকেল তিনটায় ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম আসার পথে রওনা করে। ট্রেনটি সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লার গোমতি ব্রিজ পার হওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা হঠাৎ করে ট্রেনকে লক্ষ্য করে ৩–৪টি পাথর নিক্ষেপ করে। এতে ট্রেনের জানালার কাঁচ ভেঙে ২ যাত্রীর হাতে আঘাত লাগে। এ ঘটনায় মোট ৪ যাত্রী আহত হন। তবে জানালার পাশে থাকা ২ যাত্রী বেশি আঘাত পেয়েছেন।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার মনে হয়, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মানুষকে সচেতন করার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা। এর ফলে ঘটনা কমে এসেছে। সামনে এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, গ্রামের রাস্তা দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় শিশু–কিশোররা কৌতুহলবশত এসব ঘটায়। আর এ কারণেই স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করেছি। জনসচেতনতার পাশাপাশি যেসব জায়গায় এই ধরনের ঘটনা ঘটে সেসব জায়গায় পুলিশি নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন ঘটনা যেমন কমে এসেছে, তেমনি অনেকে ধরাও পড়ছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার যেসব ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে জড়িত কমবেশি ৮০ ভাগই শিশু–কিশোর। তাদের আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময় মুচলেকা দিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত শিশু কিশোররা এক হয়ে এই পাথর নিক্ষেপের মতো ‘নিষ্ঠুর খেলা’য় মেতে ওঠে। এতে প্রায়ই যাত্রীরা গুরুতর আহত হচ্ছেন। ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ট্রেনের।
রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুঁড়লে যাবজ্জীবন জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর ছোড়ায় যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারায় দোষীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শিশু ও কিশোর জড়িত থাকায় তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হয়।
রেলওয়ে সূত্রমতে, সারাদেশে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলার ওপর দিয়ে চলার সময় ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসেবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের ৩৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি। পাথর ছোঁড়ার বেশি ঘটনা ঘটছে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে সীতাকুণ্ড অংশে। এ ছাড়া নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেজগাঁও, কাওরান বাজার, ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতৈল কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর, ফৌজদারহাট, সীতাকুণ্ড, চৌমুহনী, কুমিল্লার শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা এলাকায়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান আজাদীকে বলেন, জড়িতরা বেশির ভাগই শিশু। কয়েকজন টিনএজার একসঙ্গে হলেই ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। আমরা এসব শিশু কিশোরকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা কোনও কারণ বলতে পারে না। অকারণেই তারা ট্রেনের জানালা টার্গেট করে পাথর নিক্ষেপ করে। তিনি বলেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন একটি ফৌজদারি অপরাধ। প্রাথমিকভাবে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে অন্তঃত তিনদিন পাথর নিক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও তার আশপাশের এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। কোথাও কোথাও মাইকিং করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের সঙ্গে রেলওয়ে পুলিশের সমন্বয়ে একাধিক টিম গঠন করা হয়েছে। ওইসব টিম বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। সবাই মিলে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করলে এ ব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।