হেরেমে চেঙ্গিস খান : ২
তবে কি ধরে নেবো যে চায়নিজরা খুব শান্তিপ্রিয় জাতি ছিল প্রাচীন কালে, যারা কখনো কোন যুদ্ধ বিগ্রহ করতো না? যেতো না ভিন্নদেশ দখল করতে? কিন্তু তাও তো না। তা যদি হতোই তবে নৌবাহিনীই বা তারা বানিয়েছিল কি কারনে? মানব সভ্যতার ইতিহাস অল্প বিস্তর যতোটা জানি, তা তো যুদ্ধে যুদ্ধে যুদ্ধাকার, আর খুনে খুনে খুনাকার লাল। তবে কি ব্যাপারটা এমন যে, বিশাল বিস্তৃত ভূমিতে গড়ে উঠা চায়নিজরা, অন্য দেশের বা জাতির সাথে যুদ্ধ করার ফুসরতই পায়নি, প্রাচীন কালে নিজেরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে। যতোটা মনে পড়ে চায়নায় হান জনগোষ্ঠীর চায়নিজরা তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, এ মুহূর্তে চায়নায় বসবাস করে আরো কমপক্ষে পঞ্চাশেরও বেশিসংখ্যক নৃগোষ্ঠীর মানুষ। একই রকম নিশ্চয় ছিল অতীতে, কিম্বা ছিল আরো বেশি। অতএব নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করার জন্য ছুঁতার তো তাদের অভাব ছিল না কখোনই।
আচ্ছা নৃশংসতার জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত যে চেঙ্গিস খান, সে কি চায়নিজ ছিল? জীবিতাবস্থায় চেঙ্গিস খান তো নাকি এক্কেবারে এশিয়ার এক তৃতীয়াংশই দখল করে ফেলেছিল। আর তা করতে গিয়ে তার সৈন্যবাহিনীর হাতে সে সময়ে খুন হয়েছিল ২ কোটি থেকে ৪ কোটি আদম সন্তান! জন্মস্থান তার ছিল মনে পড়ে মঙ্গোলিয়ায়। হ্যাঁ, এই চেঙ্গিসের কথাও কিন্তু প্রথম শুনেছিলাম আমি আব্বার কাছেই। এক্ষেত্রেও উনি চেঙ্গিসের নৃশংসতার কথাই বলেছিলেন শুধু। আরো মনে পড়লো, সম্ভবত আব্বা বলেছিলেন যে চায়নিজরা তাদের বিখ্যাত গ্রেট ওয়াল নাকি বানিয়েছিল ঐ মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই। সেদিক থেকে মঙ্গোলিয়ান রা তো চায়নিজ হওয়ার কথা না। তবে এই জাতিসত্তার ধারণাটি না হলেও, রাষ্ট্রবিষয়ক ধারনাটি তো দশকে দশকে না হলেও শতকে শতকে বদলেছে। সেক্ষেত্রে কে জানে, এখন যে তিব্বত নিয়ে চায়না অহোরাত্রি ঝামেলা করছে, সেই তিব্বত আর মঙ্গোলিয়াও কি চায়নার অংশ ছিল নাকি প্রাচীনকালে?
না পরিষ্কার জানি না এসব ব্যাপার, বুঝতে পারছি। এবার চায়না ঘুরে যাওয়ার পর দেশে ফিরে, এ নিয়ে একটু সুলুক সন্ধানে নামতে হবে। তবে হ্যাঁ যে চেঙ্গিস খাঁর গল্প শুনে আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়, সে চেঙ্গিসখান নিয়ে বড় হয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করার পর, আরেকটি বিষয় জানতে পেরেছিলাম যা নাকি আব্বা বলেন নি আমাকে । আর তা হলো চেঙ্গিস খানের হেরেম। প্রিয় নারী জাতির প্রতি চেঙ্গিসের বিশেষ একটা প্রেম বা মোহ ছিল এতোটাই প্রবল ছিল যে, তার হেরেম নাকি ছিল কমপক্ষে ৩০০০ সুন্দরী রমণীতে টইটুম্বুর রমণীয়! আর পিতা ও পিতামহের নারী জাতির প্রতি এই বিশেষ প্রীতিটিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে বজায় রেখেছিলেন, বংশানুক্রমে চেঙ্গিসের পুত্র ও পৌত্ররাও। তার পৌত্র কুবলাই খান নাকি ছিলেন দাদার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বড় প্রেমিক। তার হারেম নাকি ভর্তি ছিল ৭০০০ সুন্দরীতে!
চেঙ্গিস খান আর তার পুত্র পৌত্রদের প্রিয় নারীজাতির প্রতি এই অত্যধিক প্রীতি থাকার ফলাফল হিসাবে নাকি ধরা হয় পৃথিবীর ০.৫% মানুষ নাকি আজ চেঙ্গিস খানের বংশের ধারা বহন করে বেড়াচ্ছে তাদের রক্তে। এছাড়া কোথায় যেন একবার চোখে পড়েছিল যে, রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের এক হিসাবে মধ্য এশিয়ার কমপক্ষে ১ কোটি ৬০ লক্ষ পুরুষ হলেন, চেঙ্গিস খান আর তার পুত্র পৌত্রদের প্রিয়নারী জাতির প্রতি অত্যধিক প্রেমেরই ফলাফল! যার মানে দাঁড়ায় চেঙ্গিস খান যদি ২ কোটি মানুষ মেরে থাকে, তবে সে আর তার বংশধরেরা মিলে তা পূরণ করে দিয়েছে পরবর্তী কয়েক প্রজন্মে। আর ৪ কোটি মেরে থাকলে পূরণ করেছে তার অর্ধেক! একথা ভাবতেই মনের ভেতরের দ্বিতীয় জন উঠলো এক্কেবারে ধমকে! বলে উঠলো সে, এ কোন নিষ্ঠুর হিসাব করছো তুমি! এটা কি কোন কথা হল? দেশ দখলের নাম মানুষ মেরে ফেলার মতো জঘন্য অপরাধের এরকম কোন ক্ষতিপূরণ তো আরও বেশি জঘন্য অপরাধ!
‘পাস্তেন ইউর সিত বেল্ট’ পুরুষালি গলার এই চিংলিশের এটুকু এসময় কানে যেতেই, দ্বিতীয় জনের ঐ ধমকের জবাবে লা জবাব প্রথমজন কোন কথা খুঁজে পাওয়ার আগেই, উঠে আসতে হলো ভাবনার ডুবসাঁতার থেকে। বুঝলাম এরই মধ্যে কখন যে গোটা বিমানের খাবারের থালা বাসনকোসন গোছগাছের কাজ শেষ করে ফেলেছে দু চায়নাবিমান বালা, তা আসলে টেরই পাইনি।এই মুহূর্তে সিট বেল্ট বাঁধারএই ঘোষণা আসা মানেই তো হলো অচিরেই নামতে শুরু করবো আমরা পিকিং মানবের দেশের মাটির দিকে। কিন্তু এদিকে যা ভেবে নিয়েছিলাম হাতে চায়না ভ্রমণের ফাইলটি পিঠ ব্যাগ থেকে বের করে তা তো দেখাই হয় নি। আগামী কালকের বেইজিং ভ্রমণের পরিকল্পনা করে এগিয়ে রাখবো কাজ, এরকম ভেবেই তো নিয়েছিলাম তা হাতে। কিন্তু তা তো করাই হয় নি, এমন কি এটাও এখনো ঠিক করতে পারিনি যে, এয়ারপোর্ট থেকে যাবো কিভাবে হোটেল পর্যন্ত। এমন ভাবনা আসতেই কোলের উপর রাখা সে ফাইলটি হাতে তুলে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে ওটার বেইজিং অংশ খুঁজতে শুরু করতেই ‘বাবা আমরা কি চলে এসেছি বেইজিং’ পাশ থেকে বলে উঠলো ঘুমভাঙা গলায় অভ্র।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক