লিভার প্রতিস্থাপনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতাল, কলকাতা। কলকাতায় এ পর্যন্ত অর্ধশত লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছে। এর মাঝে অন্তত ২৫টি হয়েছে অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালে। আর লিভার প্রতিস্থাপনের এসব অপারেশনের ৯০ ভাগই সাকসেসফুল। গতকাল শুক্রবার দুপুরে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এক বছর আগে লিভার প্রতিস্থাপন করা ২ বছর বয়সী শিশু রিজওয়ান আলী ও তার মা রিনা বিবিও উপস্থিত ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। এদিনই (গতকাল) পূর্ব ভারতের এই হাসপাতালটিতে প্রথম একক লিভার প্রতিস্থাপন ইউনিট চালু করা হয়। ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. রামদীপ রায়ের নেতৃত্বাধীন এই দলে থাকছেন অভিজ্ঞ দুই চিকিৎসক ডা. সুমিত গুলাটি ও ডা. সুপ্রিয় ঘটক।
শিশু রিজওয়ানের লিভার প্রতিস্থাপনের সাফল্যের গল্প তুলে ধরে হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়– দুই বছরের রিজওয়ান আলী, তার বয়সী যে কোনো শিশুর মতোই অবিরাম দৌড়ে বেড়ায় তার বারাসতের বাড়িতে। কিন্তু তাকে হেসে খেলে বেড়াতে দেখে তার মা অবাক হয়ে যান। কারণ ঠিক এক বছর আগে রিজওয়ানের লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালে। লিভার দান করেছিলেন তিনি (মা) নিজেই। প্রতিস্থাপনের ১ বছর পরে ভারতে প্রতিস্থাপিত লিভারের কনিষ্ঠতম জীবিত গ্রহীতা এই শিশুটি এখন দারুণ চনমনে হয়ে উঠেছে। গতকালের আয়োজিত অনুষ্ঠানে রিজওয়ানই ছিল সবার নয়নের মণি। রিজওয়ানের একটা জন্মগত সমস্যা ছিল, যার নাম এক্সট্রা হেপাটিক বাইলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়া। এই সমস্যা থাকলে লিভারে তৈরি হওয়া পিত্ত অন্ত্রে পৌঁছায় না, কারণ পিত্তনালী অনুপস্থিত। এর ফলে ক্রমশ লিভারের অপূরণীয় ক্ষতি হতে থাকে, তারপর ইনফ্যান্টাইল সিরোসিস অফ লিভার হয়। রিজওয়ানকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় ছিল লিভার প্রতিস্থাপন। এ কথা জানার পর রিজওয়ানের মা রিনা বিবি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। সন্তানকে নতুন জীবন দিতে নিজের লিভার দান করার সিদ্ধান্ত নেন গৃহবধূ রিনা। রিজওয়ানের বাবা পেশায় একজন সবজি বিক্রেতা। এক বড় বোনও আছে রিজওয়ানের। রিনা বিবি বলেন, অপারেশনের আগে আমার ছেলের প্রস্রাব ছিল গাঢ় হলুদ আর পায়খানা সাদা। সারাক্ষণ কাঁদত আর একদম ঘুমোতে পারত না। আমরা যখন জানলাম ওর অসুখটা কী, তখন ভেবেছিলাম ওকে আর রাখতে পারব না। ‘ভাগ্যিস অপারেশনটা করাব ঠিক করেছিলাম, এখন তো আমার ছেলে পুরোপুরি সেরে উঠেছে’ যোগ করেন তিনি। পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ডা. শুভময় দাস জানান, ‘বাবা–মায়েদের বাইলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়ার লক্ষণগুলো চিনতে পারা খুব জরুরি। এর মধ্যে গাঢ় হলুদ প্রস্রাব আর ফ্যাকাশে পায়খানাও পড়ে। যত তাড়াতাড়ি অসুখটা ধরা পড়ে, ফলাফল তত ভাল হয়। এই বাচ্চাটাকে যখন আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন ওর মরো মরো অবস্থা। এরপরেও আমরা ছেলেটার মায়ের প্রশংসা করি, কারণ উনি একেবারে সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ দাতা হতে রাজি হয়েছিলেন। তিনি বলেন, অসুখটা ধরতে পারা বেশ কঠিন। কারণ লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে বাচ্চাদের যখন কয়েক মাস বয়স সেই সময়। ওই বয়সে বাচ্চারা নিজেদের অসুবিধা বোঝাতে পারে না। ফলে অনেক বাবা–মায়েরাই বাচ্চার কান্নার কারণ যে কোনো ব্যথা, সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। প্রতিস্থাপনের পর রিজওয়ানের ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছিল এবং তার অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছিল। কিন্তু অ্যাপোলো গ্লেনইগলসের এক মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ডাক্তারদের টিম তাকে সারিয়ে তোলে। অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালের ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোসাইন্সেজ অ্যান্ড লিভারের ডিরেক্টর ডা. মহেশ কুমার গোয়েঙ্কা বলেন, বিভিন্ন বয়সের বহু মানুষ নানা অসুখের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। তাদের কাছে লিভার প্রতিস্থাপন হল শেষ আশা। যদিও অ্যাপোলো গ্লেনইগলসে আমরা বহু বছর ধরেই লিভার প্রতিস্থাপন করছি, এই মুহূর্তে দরকার এক টিম সার্জন যারা এককভাবে লিভার প্রতিস্থাপনই করবেন। নিজেদের হাসপাতালে এখন একটা প্রতিভাবান টিম রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যার নেতৃত্বে আছেন ডা. রামদীপ রায়। আর তাঁর সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন ডা. সুমিত গুলাটি আর ডা. সুপ্রিয় ঘটক। আমরা ভাগ্যবান যে এদের সঙ্গে আছেন অত্যন্ত প্রতিভাবান জি আই লিভার প্রতিস্থাপন ইনটেসিভিস্ট ডা. ইন্দ্রজিৎ তিওয়ারি। অ্যাপোলো হাসপাতাল গ্রুপের সিইও (ইস্টার্ন রিজিয়ন) রাণা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা সব সময়েই আমাদের রোগীদের সেরা পরিষেবা দিতে সাধ্যাতীত চেষ্টা করি। আর ডাক্তারদের পারদর্শিতা সেই চেষ্টা সফল করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডা. মহেশ গোয়েঙ্কা আর তার ক্রিটিকাল কেয়ার টিম বহুদিন ধরে অসাধারণ কাজ করে চলেছেন। ডা. রামদীপ রায়ের অধীন অ্যাপোলো গ্লেনইগলসের প্রথম ইন–হাউস একক লিভার প্রতিস্থাপন টিম (পূর্ব ভারতের যে কোন হাসপাতালেরই প্রথম) আমাদের মুকুটে আরেকটা পালক যোগ করল। আমি নিশ্চিত এই টিম আগামীদিনে আমাদের অনেক সম্মান এনে দেবে। এক প্রশ্নের জবাবে ডা. মহেশ গোয়েঙ্কা জানান, লিভার প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে ভারতীয় মুদ্রায় ২৩ লাখ রুপি। তবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দূর অঞ্চল থেকে আসা রোগীদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হবে। সুস্থ যে কেউ লিভার দান করতে পারে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, লিভার দান করার পূর্ব শর্ত দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ম্যাচিং হতে হবে। আর দাতাকে সুস্থ সবল হতে হবে।