যে কোন উন্নয়নশীল দেশের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। তাই আমরা দেখছি এক দশক ধরে আমাদের দেশে অভাবনীয় মাত্রায় ভৌত যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি ঘটছে। নতুন নতুন ফ্লাইওভার সড়ক–মহাসড়ক বড় বড় সেতু নির্মাণ হচ্ছে, নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করতে ভৌত অবকাঠামোর এই চলমান উন্নয়ন অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো এক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতার ছাপ স্পষ্ট।
যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রকৌশলগত অদক্ষতায় উপর্যুপরিভাবে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর নকশায় নিয়মিত বিরতিতে নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ছে। এর আগে রাজধানীর মগবাজার–মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। পরে সেটি সংশোধন করে বাড়তি ব্যয় ও সময় নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। সম্প্রতি ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনায় ঢাকা–ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়ক নির্মাণ হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, যার কারণে দ্রুতগামী গাড়িগুলো কাঙ্ক্ষিত গতিতে চলতে পারছে না এবং প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প পদ্মাসেতু রেললাইনের নকশায়ও ত্রুটি ধরা পড়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী রেল লাইনের ডায়াডাবেটর নিম্নভাগ থেকে সড়কের উচ্চতা ৫ দশমিক ৭ মিটার এবং জাতীয় মহাসড়কের প্রস্থ ১৫ দশমিক ৫০ মিটার হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান নকশায় উচ্চতা ও প্রস্থ দুই দিকেই জায়গা তুলনামূলক কম। ফলে সব ধরনের যানবাহন, বিশেষ করে লরি চলাচল করতে পারবে না বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে উঠে এসেছে। এটা প্রকৌশলগত অদক্ষতা ও দুরদর্শিতাহীনতারই পরিচায়ক। একটি প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের আগে কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। কোনো ধাপেই এ ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ল না, অথচ নির্মাণের সময়ে এসে ধরা পড়ল–এটি সত্যিই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এ জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা অবশ্যই প্রয়োজন।
এদিকে নির্মাণে ত্রুটি পেয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে বিদ্যমান নকশা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তেই রেললাইনের নকশায় ত্রুটি আছে বললেও রেল সংযোগে সংশ্লিষ্টরা শুধু জাজিরা প্রান্তেই সমস্যা রয়েছে বলছেন। বিষয়টি যথাযথভাবে খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এরই মধ্যে অনেকখানি এগিয়েছে। সেতুমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বাস্তবায়নাধীন সেতুটির সার্বিক কাজ ৯০ শতাংশের কাছাকাছি সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় রেললাইনের নকশা সংশোধনে অযাচিত বিলম্ব মোটেই কাম্য নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে এক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশে একটি নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে, যে কোনো প্রকল্পে ত্রুটি দেখা দিলে তা সংশোধনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয় কিংবা বিদ্যমান প্রকল্পে ব্যাপকভাবে সংশোধন আনা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই নতুন করে অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। এ ধরনের অর্থ ব্যয় রাষ্ট্রীয় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়। পদ্মা সেতুর রেললাইনের ত্রুটিপূর্ণ নকশা সংশোধনে এ ধরনের প্রবণতার পুনরাবৃত্তি দেশবাসীর অভিপ্রেত নয়। এ ধরনের প্রবণতা দূর করতে হলে, প্রথমত নকশায় ত্রুটির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত এ জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করা চলবে না। তৃতীয়ত অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণ যে কোনোভাবে এড়াতে হবে। কীভাবে এক্ষেত্রে ক্ষিপ্রতা আনা যায়, জরুরি ভিত্তিতে তার উপায় বের করতে হবে।
যে কোনো অবকাঠামোর স্থায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করে প্রকৌশলগত সঠিকতা এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। বিপুল অর্থ ব্যয়ে আলোচ্য অবকাঠামো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলকে সড়ক ও রেললাইনের মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে এটিই হবে সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু অবকাঠামো। বছর বছর এ ধরনের সেতুর নির্মাণ বা সংস্কার সম্ভব নয়। সুতরাং কমপক্ষে ১০০ বছরের পরিকল্পনা করে এক্ষেত্রে অগোনো উচিত, যাতে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে নতুন করে সেখানে আর কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা না লাগে। কিন্তু নির্মাণের শুরুতে আলোচ্য অবকাঠামো নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ায় এর মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে মানে যেন কোনো ধরনের আপোস না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে।
অর্থনৈতিক পরাক্রমের দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩২তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের গন্তব্য হয়ে উঠেছে আমাদের দেশ। বিনিয়োগের পরিপূরক ও সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে উন্নত মানের যোগাযোগ অবকাঠামোর বিকল্প নেই। কিন্তু গৃহীত প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও মানে যে ধরনের ঘাটতি ধরা পড়ছে তাতে উন্নত মানের অবকাঠামো ও এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা কঠিন। এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। তাই ভবিষ্যৎ যে কোন প্রকল্পের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যাপ্ত সকল ধাপেই বাঞ্ছনীয় মান বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন জনগণ দেখতে চায়।