বাংলাদেশে গরু পাচারকারী চক্রের সন্ধানে নেমে তাতে বিএসএফ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই। পাশাপাশি এই চোরাকারবারে রাজনীতিকদেরও জড়িত থাকার বিষয়টি অনুসন্ধানে উঠে আসায় তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে হৈ চৈ পড়েছে। সিবিআইর প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাতে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, বিএসএফের অন্তত ছয়জন পদস্থ কর্মকর্তা এবং কয়েকজন শুল্ক কর্মকর্তা মোটা মাসোহারা পেতেন পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচারের তদন্তে নেমে গত মঙ্গলবার এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই।
গত বুধবার কলকাতা, সল্টলেক, রাজারহাট, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং অন্য রাজ্য মিলিয়ে ১৩টি জায়গায় তল্লাশি করে সিবিআই। রাজ্যের বাইরে তল্লাশি হয় অমৃতসর, গাজিয়াবাদ ও রায়পুরে। রাজ্যের গরু পাচার চক্রের হোতা হিসেবে বিশু শেখ ওরফে এনামুল হক এবং তার মদদদাতা হিসেবে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী- বিএসএফের কর্মকর্তা সতীশ কুমারকে চিহ্নিত করেছে সিবিআই। খবর বিডিনিউজের।
সতীশ বর্তমানে ছত্তিসগড় রাজ্যের রায়পুরে কর্মরত। সেখানেও তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। তার গাজিয়াবাদের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। সিলগালা করা হয়েছে তার কলকাতার সল্টলেকের বাড়ি। এনামুলের গ্রাম মুর্শিদাবাদের কুলগাছিয়াতে তার দুই সহচর গোলাম মোস্তাফা ও আনারুল শেখের বাড়িতেও তল্লাশি চালায় সিবিআই। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত বিএসএফের এক কমান্ডেন্ট জিবু ডি ম্যাথিউকে ২০১৮ সালে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বিপুল অর্থসহ গ্রেপ্তার করা হয়। সেই তদন্তেই উঠে আসে, ওই অর্থ তিনি ঘুষ হিসাবে পেয়েছিলেন গরু পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে। জিবুকে জেরা করেই তখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ব্যবসায়ী এনামুল হককে। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
সিবিআই কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, এক জোড়া গরু সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে এনামুলের সিন্ডিকেট কমপক্ষে ৩২ হাজার টাকা নিত। গরু বড় হলে এই অর্থ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় উঠত। গরু পাচার নিয়ে সিবিআইর ২০১৮ সালে প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সাল থেকে মালদহ-মুর্শিদাবাদ সীমান্তে গবাদি পশু পাচারের সব চক্রকে ছাপিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল এনামুলের চক্র। এই একচেটিয়া কারবারে রাজ্যের একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মদদের কথা সিবিআই হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন বলেও সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা জানান।
তারা বলছেন, শুধু জিবু নন, মালদহ-মুর্শিদাবাদে কর্মরত বিএসএফের একাধিক কমান্ডেন্ট গবাদি পশু পাচারে মদদ জোগান মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে। সিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, বিএসএফ কমান্ডেন্ট জিবু তার সহকর্মী সতীশ কুমারের মাধ্যমে বিশু শেখের সঙ্গে আলাপের কথা বলেছিলেন। গাজিয়াবাদের বাসিন্দা সতীশ ২০১৫ সালে মালদহের ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পান। পরের বছরই ৮৩ ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পান জিবু। এই দুটি ব্যাটালিয়নই মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের রানিনগর থেকে ধূলিয়ান পর্যন্ত এলাকায় মোতায়েন ছিল। সিবিআই কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে আনন্দবাজার লিখেছে, গবাদি পশু পাচার ওই এলাকার দীর্ঘ দিনের কারবার। একাধিক সিন্ডিকেট যুক্ত ছিল ওই ব্যবসায়। ২০১৫ সালে এতে নামেন এনামুল। সেই সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলার এক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা তাকে সাহায্য করেন। তার সমর্থনের জোরেই বাকিদের হটিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
প্রাথমিক তদন্তে সিবিআই কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, অন্য রাজ্য থেকে গবাদি পশু প্রথমে এসে পৌঁছত বীরভূমের ইলামবাজারে বিশু শেখের এক ডেরায়। সেখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে বাংলাদেশে পাঠানো পর্যন্ত দায়িত্ব ছিল বিশু শেখের চক্রের।
এক সিবিআই কর্মকর্তা আনন্দবাজারকে বলেছেন, স্ট্যাম্প মেরে রীতিমতো ঘোষণা করে ব্যবসা করত বিশু। রাজ্য প্রশাসনেরও একটা বড় অংশ, বিএসএফ বা শুল্ক দপ্তরের মতো আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে বিশুর কাছ থেকে। জেরায় বিশু ওরফে এনামুল নিজেই জানিয়েছেন, ইলামবাজার থেকে সীমান্ত পর্যন্ত কেউ যাতে তার গবাদি পশু না আটকায়, তার জন্যই স্ট্যাম্প মারা হত। রাজ্য রাজনীতিতে খুব ভালো রকম প্রতিপত্তি না থাকলে এ ভাবে রমরমিয়ে বেআইনি কারবার চালানো সম্ভব নয়। সীমান্তে না হয় পাচারে সাহায্য করত বিএসএফ এবং কাস্টমস, কিন্তু বাকি পথে বিশুর গবাদি পশু আটকানো হত না কেন? সিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল নাগাদ সতীশ কুমার এ রাজ্যে বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমাডেন্ট ছিলেন। ওই ১৬ মাসে তার বাহিনী মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্তে বাজেয়াপ্ত করেছিল প্রায় ২০ হাজার গরু। কিন্তু বাজেয়াপ্ত করা সেই গরুকেই বিএসএফের সরকারি নথিতে করা হচ্ছিল বাছুর। এর পর গরুর যা দাম, তার অনেক কম দামে সেই ‘বাছুর’ নিলাম হত স্থানীয় বাজারে। আর নিলামে সেই গরু ফের কম দামে কিনে নিত বিশু শেখরা। নিলামে কিনে নেওয়া ওই গরুই ফের সীমান্ত পেরিয়ে পাচার করা হত বাংলাদেশে। বিএসএফের জন্য বরাদ্দ থাকত গরু প্রতি ২ হাজার টাকা। আর ৫০০ টাকা কাস্টমসের জন্য। বিশু শেখ সিবিআইকে বলেছেন, বিএসএফ, কাস্টমস ছাড়াও অনেকেই অর্থনৈতিক লাভবান করেছেন তিনি। তার দাবি কতটা ঠিক, তা এখন খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
সিবিআই প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, সতীশ ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচ জন পদস্থ বিএসএফ এবং কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তা মোটা মাসোহারা পেতেন বিশু শেখের কাছ থেকে। তালিকায় বিএসএফের নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। জেরায় বিশুর দাবি, নিলামে কারচুপির পাশাপাশি, প্রতি সপ্তাহে তিন দিন মোটা অর্থের বিনিময়ে সীমান্তের নির্দিষ্ট অংশ প্রহরামুক্ত করে দেওয়া হত ১ থেকে ৩ ঘণ্টার জন্য। তার জন্য গবাদি পশু প্রতি ৫ হাজার টাকা দিতে হত নিকটবর্তী সীমান্ত চৌকি বা বর্ডার আউটপোস্টকে, লিখেছে আনন্দবাজার।
সিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগস্ট মাসেই আমরা জিবু ও এনামুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করে ফেলেছি। আদালতে তা পেশ করতে গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সবুজ সঙ্কেত লাগবে। কারণ জিবু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কর্মরত পদস্থ কর্মী। তবে নতুন মামলার অনুমতি পাওয়া গেছে বলে তার ভিত্তিতে নতুন মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তদন্তকারীদের ইঙ্গিত, এই মামলায় ফের এনামুলকে হেফাজতে নেওয়া হতে পারে। সতীশ কুমারকেও প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।