কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বন্দরের রশি টানাটানি চলছে। এমন অভিযোগ করে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নেতৃবৃন্দ। বলেছেন, উচ্চ আদালতের আদেশ ও নির্দেশনা থাকার পরেও অবৈধ দখল উচ্ছেদ হচ্ছে না। গত ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘দখল-ভরাটে অর্ধেক সরু হয়ে গেছে কর্ণফুলী’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হলেও তা আবার থমকে গেছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও অদৃশ্য কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গায় গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদ করার কথা থাকলেও সামপ্রতিক সময়ে ‘বন্দরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে’ উল্লেখ করে দায় সারছে জেলা প্রশাসন। সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটির (জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ) বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালনে গড়িমসির অভিযোগও করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী সেতু নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬.১৬ মিটার। কিন্তু সামপ্রতিক চালানো জরিপে শাহ আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটারে নেমেছে। তাছাড়া কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে নদীর দক্ষিণ অংশে ব্যাপক স্রোতের সৃষ্টি হয়। স্রোতের এই তীব্রতার চাপ কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশের পিলারে পড়ছে। যা শাহ আমানত সেতুর জন্য বিপজ্জনক। এতে বন্যা বা সাইক্লোন হলে শাহ আমানত সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গত ১৭ আগস্ট আজাদীতে প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনে কর্ণফুলী উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু নিয়ে আইনি লড়াইকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। তিনি বলেছেন, , করোনা শুরু হওয়ার এক মাস আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সর্বশেষ সময় নিয়েছিল হাইকোর্ট থেকে। করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় তা আর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু এর আগের যে আদেশগুলো আছে তা দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তিনি আরো বলেন, উচ্ছেদ ঠেকাতে করা মামলা আপিল বিভাগ থেকে আমি দুইবার ক্লিয়ার করে দিয়েছি। এ অবস্থায় প্রশাসন চাইলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে পারে। যদি ব্যত্যয় হয় তাহলে সময় সুযোগ বুঝে আবার আমরা আদালতের দ্বারস্থ হব।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ আদেশ আসার ৯০২ দিন পর ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী তীরে অবৈধ স্থাপনায় হাত পড়েছিল জেলা প্রশাসনের। সদরঘাট এলাকা থেকেই এ অভিযান শুরু হয়েছিল। টানা ৫ দিন অভিযান চালিয়ে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত পরিচালিত এ অভিযানের মাধ্যমে নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ৪ যুগেরও বেশি সময় ধরে কর্ণফুলীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদে প্রথম পর্যায়ে টানা অভিযান চললেও পরে তা আর অব্যাহত রাখা যায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ছয়টি সুপারিশ দেওয়া হয়। তন্মধ্যে রয়েছে, অবিলম্বে কর্ণফুলী মেরিনার্স পার্ক, সোনালী মৎস্য আড়ত, বেড়া মার্কেটসহ কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর গতিপথ ফিরিয়ে আনা, নিয়মিত ড্রেজিং করে ও প্রয়োজনীয় নদীশাসনের মাধ্যমে বাংলাবাজার, সদরঘাট, চাক্তাই ও রাজাখালী এলাকার নৌবন্দর ঝুঁকিমুক্ত করা, নদীর পাড় স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা এবং প্রস্তাবিত হাইড্রো মরফলোজিক্যাল মডেল স্টাডির মাধ্যমে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রবাহ ও নদীশাসনের কাজ সম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা নেয়া। এসব সুপারিশ দ্রুত বিবেচনায় আনা জরুরি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বন্দরের রশি টানাটানি বন্ধ হওয়া চাই।
কর্ণফুলী নদীর দূষণ রোধ, অবৈধ দখল বন্ধ ও নাব্যতা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান নানা সময়ে করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। কর্ণফুলীর বর্তমান অবস্থা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ নদীর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কর্ণফুলী রক্ষায় নগরবাসীকেও আরো সোচ্চার হতে হবে।