চট্টগ্রামের বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি আল ভাণ্ডারী) ফটিকছড়ি থানার সুয়াবিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আমির হোসেন এবং মাতা সৈয়দা আনোয়ারা বেগম। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই ছবি আঁকায় তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকার। সেটি হয়ে উঠেনি। কারণ হিসাবে বলেছেন, “সামাজিক বৈপরীত্য, সমাজের নানান সমস্যা, অবিচার এসব তাঁকে ভাবিয়ে তুলত। এর থেকে উত্তরণে ছবির মাধ্যমে মানুষের কাছে সরাসরি বক্তব্য পৌঁছানো যায় না। তাই গানের মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। তখন সংগীতের কথা ও সুর তাঁর মনে দোলা দিত। গান লেখার ইচ্ছা জাগত। এই অবস্থায় সুন্দর সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে গান লেখার প্রতি তিনি ঝুঁকে পড়েন।” তাঁর সৌভাগ্য, নিজগ্রাম সুয়াবিলে বাড়ীর পাশে “গুরুদাশ বাবার” একটি আশ্রম ছিল। সেটি এখনো ভক্ত সমারোহে সমুজ্জ্বল। আশ্রমটির অধ্যক্ষ হেম মজুমদার ছিলেন সংগীত বিশেষজ্ঞ। আশ্রমটিতে সন্ধ্যার সময় ভক্তিমূলক গান হত। গ্রামে বসবাসকালীন সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি আল ভাণ্ডারী) অধ্যক্ষ হেম মজুমদারের কাছে সংগীত চর্চা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে আশ্রমটিতেই তিনি সংগীতকে ধ্যান-জ্ঞান হিসাবে বরণ করেন।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কুমিল্লায় ওস্তাদ সুরেন দাশের কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত তালিম নেন। দেশ হানাদার মুক্ত হলে গান রচনা ও সুর চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিনি মূলত রাগ প্রধান ও আধুনিক গান রচনা ও সুরারোপে আগ্রহী ছিলেন। আধুনিক গান রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এখনো রাগপ্রধান এবং আধুনিক গান রচনা ও সুরারোপ করে থাকেন। উল্লেখ্য তাঁর রাগ প্রধান গানের একক শিল্পী হচ্ছেন কাবেরী সেন গুপ্তা। ১৯৮০ এর দশকের প্রথমে বাংলাদেশ বেতার চট্টগাম কেন্দ্রে আধুনিক গানের পান্ডুলিপি জমা দেন। যে বছর জমা দেন সে বছরই বেতারের গিতিকার হিসাবে অনুমোদন লাভ করেন। এরপর নিয়মিত আধুনিক গান রচনা করতে থাকেন। সেসময় বাংলাদেশের বর্তমানের বিখ্যাত কন্ঠ শিল্পী তপন চৌধুরী চট্টগ্রাম বেতারে “উপহার অনুষ্ঠানে” তাঁর কথা ও সুরে গান করেন। সৈয়দ মহিউদ্দিনের কথা ও সুরে চট্টগ্রাম বেতারে তপন চৌধুরীর গাওয়া একটি গানের ১ম কলি ছিল এরকম, “জলের অপর নাম জীবন হয়েছে হোক, আমার জীবন নাম তুমি”। বুঝা যায়, ১৯৮১ সালেই সৈয়দ মহিউদ্দিন গান রচনা ও সুর করায় সিদ্ধ হস্ত হয়ে উঠেন।
আধুনিক গান রচনার পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গান রচনায় হাত দেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি ভাবলাম, চট্টগ্রাম অঞ্চলের শ্রোতারা আধুনিক গানের চাইতে আঞ্চলিক গান বেশী শোনেন। কিন্তু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান আঞ্চলিক ভাষার গান না হয়ে মিশ্র ভাষার হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমার ইচ্ছে হল বিশুদ্ধ চাটগাঁইয়্যা আঞ্চলিক গান লেখার। অতপর আঞ্চলিক গান এবং শফি বাবার ভক্ত হিসাবে মাইজভাণ্ডারী গান রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করি”।
সৈয়দ মহিউদ্দিন ১৯৭৮ সালে দৈনিক আমার বাংলা পত্রিকায় কাজ করার জন্য ঢাকায় চলে যান। তিনি দৈনিক আমার বাংলায় ঢাকায় ১ বৎসর কাজ করেন। ঢাকায় তিনি মোহাম্মদপুরে থাকতেন। সেখানে অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক ও গুণীজনের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। এরপর ঢাকায় দেশের প্রথম সংগীত পত্রিকা মাসিক সংগীত- এর সাথে জড়িত হন। পত্রিকাটির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন ৩ বৎসর। ঢাকায় অবস্থান করে চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করতেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগীত বিদ্যালয়ে পত্রিকাটি বিতরণ করতেন। সংগীত শিক্ষার্থীরা এটি লুফে নিত। পত্রিকাটি বর্তমানে মাসিক সরগম নামে প্রকাশিত হয়। মাসিক সংগীত পত্রিকা ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত গীতিকার মলয় ঘোষ দস্তিদারকে ঢাকায় সম্মাননা প্রদান করে। পত্রিকাটির জন্য মলয় ঘোষ দস্তিদারের উপর লেখা তৈরীর দায়িত্ব পান সৈয়দ মহিউদ্দিন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে গীতিকার মলয় ঘোষ দস্তিদার সম্পর্কে ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া, নৃত্যশিল্পী রনু বিশ্বাস, গল্পকার সুচরিত চৌধুরী, কন্ঠশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব ও কন্ঠশিল্পী শেফালী ঘোষের বক্তব্য সংগ্রহ করেন তিনি। এই সূত্রে শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে। তখন এই দুইজন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী। এরপর চট্টগ্রাম বেতারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় তিনি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম চলে আসেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে এসে উস্তাদ প্রিয়দা সেন গুপ্তের একান্ত সান্নিধ্যে সংগীতের নানান বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তখন সংস্কৃতিকর্মী সুজিত ভট্টচার্য্য দোলনকে মাসিক সংগীত পত্রিকার দায়িত্ব অর্পণ করেন। চট্টগ্রাম চলে এসে চট্টগ্রাম শহরের শুলকবহরে বাসা নেন। এসময় চট্টগ্রামের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের বাসা ছিল কাতালগঞ্জ। দুজনের বাসা ছিল ৫ মিনিট দূরত্বে। একদিন শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় উনার বাসার গলিতে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে দেখতে পান। তখন শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব বলে উঠেন , “কি মসাই, আপনি এখানে? আপনি তো ঢাকায় থাকেন। কেমন আছেন? কিজন্য এসেছেন?” সৈয়দ মহিউদ্দিন তাঁকে বললেন, আমি চট্টগ্রাম বেতারে গীতিকার হিসাবে অনুমোদন পেয়েছি। এখন চট্টগ্রামে থাকি। এখানেই বাসা নিয়েছি। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব বললেন, আপনাকে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে হবে। সৈয়দ মহিউদ্দিন একদিন শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের বাসায় যান। সেখানে দুজনের আলাপ হয় এরকম, আপনি তো আধুনিক গান লিখেন। আমার জন্য কিছু আঞ্চলিক গান লিখেন। সৈয়দ মহিউদ্দিন বললেন, আধুনিক গান লিখলেও বাপ-দাদার মুখের কথায় আমার আঞ্চলিক গান লেখা আছে। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব বললেন, পুরান আঞ্চলিক গানতো বোথ গাআই, বিটিভির লাই আঁরে ওগ্যা নোয়া গান দঅন। এই অবস্থায় তিনি শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবকে “অ জেডা ফইরার বাপ, একদিন বুঝিবা জেডা, একদিন বুঝিবা” গানটি কন্ঠে তোলা অর্থাৎ শিখিয়ে দেন।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের কথা ও সুরে এই গানটি সম্ভবত ১৯৮২ অথবা ৮৩ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হয়। কন্ঠ দেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব। গানটি প্রচারিত হওয়ার পর হিট হয়। চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশে ও বিদেশে চট্টগ্রামবাসীর মন জয় করে। বাংলাদেশের লোক সংগীতের ভান্ডারে এটি কালজয়ী গান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। গানটি গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিনের অমর সৃষ্টি হয়ে আছে। গানটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের খ্যাতি বাড়িয়েছে। পরে গানটিকে চট্টগ্রাম বেতারেও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের কন্ঠে বিশেষভাবে রেকর্ডিং করে নেওয়া হয়। সৈয়দ মহিউদ্দিন জানান, গানটি তিনি সুয়াবিল গ্রামে থাকার সময়ে রচনা করেন।
উল্লেখ্য, গীতিকাররা অনেক সময় গান লিখে থাকেন নিজের কল্পনা নির্ভর করে। তাই অনেক গানে অবাস্তব বিষয় থাকে। যদিও মানুষ মনে করত “অ জেডা ফইরার বাপ” গানটিও গীতিকারের কাল্পনিক। কিন্তু তা নয়। গানটি একজন মানুষের জীবনের বাস্তব ঘটনার রূপায়ন। সৈয়দ মহিউদ্দিন তরুণ বয়সে গানটি রচনা ও সুর করেন।
বিটিভিতে সৈয়দ মহিউদ্দিনের কথা ও সুরের প্রথম আঞ্চলিক গান এটি। প্রথম আঞ্চলিক গানেই তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন। চট্টগ্রাম বেতারেও গানটি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামে গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। রেডিও, টেলিভিশন ছাড়িয়ে গানটি চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে মুখে স্থান পায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলট্রেন ও ক্যাম্পাসে গানটি দীর্ঘকাল আনন্দ উপভোগের উপজীব্য হিসাবে ছাত্র ছাত্রীদের মুখে মুখে ছিল। এই গান থেকেই বলা যায়, সৈয়দ মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে একজন স্বার্থক জীবনমুখী আঞ্চলিক গানের স্রষ্টা। চট্টগ্রামের যেসব স্থানে ফইরার বাপ নামে লোক আছে, সে এলাকায় গানটি গাওয়ার সময় অনেক ফইরার বাপ খুশি হতেন। অনেকে শিল্পীকে গালমন্দ করে অনুষ্ঠান থেকে চলে যেতেন। চট্টগ্রাম বেতারে গানটি যখন প্রচারিত হয়, তখন ফইরার বাপ জীবিত ছিলেন। তিনি বেতারে গানটি শুনে হেসে হেসে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে টিটকারী করতেন। মানুষকে বুঝাতেন, “দেইখ্যঅনা আঁর নাতি মহির হান্ড, আঁর নাম রেডিওর ভুতর হই দিইয়্যে।” কিন্তু ফইরার বাপের স্ত্রী অর্থাৎ সৈয়দ মহিউদ্দিনের চাচাতো দাদী সৈয়দ মহিউদ্দিনকে বলতেন, “এই বিডাল বুইজ্জার লাই তুঁই যে গান লেইখ্যঅ, আঁই তোঁয়ারে দোয়া গড়ির।” ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে গানটির কন্ঠশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব সৈয়দ মহিউদ্দিনকে ভাই ডাকেন। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব সৈয়দ মহিউদ্দিনকে বলেন, “গানের ভূতর আঁই কি হইতাম চাই, তুঁই ছাড়া আর কেয়াই ন বুঝিব। আঁর মিক্কা চাই আঞ্চলিক গান লেহা ন ছাড়িবা”।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের আঞ্চলিক গান কথা ও সুরের ব্যঞ্জনায় আলাদাভাবে বুঝা যায়। “অ জেডা ফইরার বাপ” গানটিও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের জগতে আলাদা স্থান করে নিয়েছে। সৈয়দ মহিউদ্দিন বলেছেন, গানটি আমাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। বাপ দাদার মুখের ভাষা দিয়ে শুদ্ধ আঞ্চলিক গান লেখায় আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। শিক্ষিত সমাজ আঞ্চলিক গানকে যেন তেন গান মনে করে শুনতে চাইতনা। কিন্তু আমাকে অনেক অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক উৎসাহিত করেছেন।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের অমর সৃষ্টি কালজয়ী এই গানটি তাঁর গীতপূত্র শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের পুত্র প্রেম সুন্দর বৈষ্ণব প্রায় পিতার মতই অসাধারণভাবে গেয়ে থাকেন। “অ জেডা ফইরার বাপ, একদিন বুঝিবা জেডা” গানটির সফলতার ধারাবাহিকতায় সৈয়দ মহিউদ্দিন আরো অসংখ্য জীবনমুখী জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানের সফল গীতিকার ও সুরকার।