আজকাল অবদান স্মরণ প্রায় সুদুর্লভ। কর্মবীর জ্ঞানতাপস আবদুর রহমানের মতো রাজনীতিমুক্ত ব্যক্তিত্ব বৈষয়িক স্বার্থের কোন কাজে আসেন না। প্রভুত অবদান রেখেও অনেকে বিস্মৃতির আবরনে ঢাকা পড়েন।
বিশ শতকের প্রথম পাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস্টিজিয়াস সাবজেক্টে কৃতিত্ব অর্জনকারী আবদুর রহমান আইসিএস-বিসিএস না হয়ে হলেন স্কুল শিক্ষক। প্রয়াত আহমদ ছফার কথায় “কিন্তু আমরা সেসব বিসিএসদের স্মরণ করার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করিনে। বিসিএস পাস করা একজন সরকারি চাকুরো চাইতে প্রয়াত আবদুর রহমান অধিক কিছু ছিলেন সে কারণে আবদুর রহমানের স্মৃতির পর্যালোচনার প্রয়োজন আমরা বারবার অনুভব করে থাকি। তাঁর চরিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে একজন সম্পূর্ণ মানুষের মৌল উপাদান সমূহ অবশ্যই বর্তমান ছিল।”
যেহেতু শিক্ষা হচ্ছে জীবনের একটি সৎ অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার আলো বঞ্চিত বাঙালি মুসলমান সমাজ কাঠামো তৈরি করার দায়িত্বপূর্ণ কাজে তিনি ব্রতী হয়ে সফল হয়েছিলেন। ঐ সময়কে বোঝাবার জন্য এখন উইলিয়ম হান্টার এর সাক্ষ্য নিষ্প্রয়োজন। নির্দ্বিধায় বলা যায়-এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে কৃতিত্ব আছে মহাত্মা আবদুর রহমানের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার ছাড়াও আবদুর রহমান এদেশে বহুবিধ প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা ছিলেন। অনেকেই জানিনা-‘৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাঙলা একাডেমির প্রথম পৃষ্ঠপোষক তিনি। অর্থাভাবে যখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাঙলা একাডেমি বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল-আবদুর রহমান তাঁর মৃত্যু পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার জন্য সমুদয় অর্থ একাডেমিকে দান করেন।
এভাবে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রামের মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি, চট্টগ্রাম, বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরী ও মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্কুল স্থাপন এবং অগনিত জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে দান-অনুদান দিয়ে গেছেন। এ ধরনের সহায়তায় দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রগণ শিক্ষার আলোয় দীপ্ত হয়েছে। অবসর জীবনেও তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টাসহ বহু সম্মানজনক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর মহিয়সী স্ত্রী বেগম মোহছেনা চৌধুরী চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে আবদুর রহমান প্রয়োজনীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষত শিক্ষার আদর্শ ও প্রয়োগ সম্বন্ধে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধির জন্য মাত্রাতিরিক্ত বস্তুবাদী মনোভাব মানুষকে উম্মত্ত করে তোলে, ফলে সমাজ জীবনে অনিবার্যভাবে সংঘাত নেমে আসে। তাঁর অভিমত একটি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা জগৎ, সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে নিবিড় সংযোগ স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
মহানবী (স.) এঁর পবিত্র বাণী অনুসরণে তিনি দৃঢ়চিত্ত ছিলেন, যাতে এরশাদ হয়েছে “ ……ওয়ালাম ইয়াকূনা আলিমান, হাত্তা ইয়াকূনা বিল্্ ইল্মে আমিলান।” অর্থ-সে ব্যক্তিকে মুসলমান বলা যায় না, যে জ্ঞানী নয় এবং তাকে জ্ঞানী বলা যায় না, যে তার জ্ঞানানুযায়ী আমল করে না। ঐশী প্রত্যয় সম্ভুত এই বাণী আবদুর রহমান সমগ্র জীবনে ধারণ করেছেন।
মরহুম প্রিন্সিপাল এ.এ.রেজাউল করিম চৌধুরীর ভাষায়-‘জনাব আবদুর রহমান সাহেব গজদন্ত নিবাসী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন স্কলার ছিলেন না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাঁর বাসস্থান ছিল বুদ্ধিজীবীদের তীর্থস্থান। তাঁর মেহমানদারী, সরস জ্ঞান-আলোচনা আমাদের আত্মার দিগন্তকে প্রসারিত করতো। তাঁর মরহুমা বেগম, তাঁর সন্তানরা জনাব আবদুর রহমানের মেহমানদারীতে যে সস্নেহ ভূমিকা পালন করতেন তা কোনদিন ভুলবার নয়। জ্ঞানীগুণীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। তাঁর বাসস্থানে বুদ্ধিজীবীদের ভিড় থাকতো সবসময়।’
মরহুম আবদুর রহমানের শিক্ষা সাধনা আর রচনা আমাদের অমূল্য সম্পদ। বিপদাপদের ঘনঘটায়, দুর্যোগ দুর্দশার অমানিশায় তাঁর জ্ঞানদীপ্ত সত্তা আমাদের চেতনায় নক্ষত্রের মতো ভাস্বর হয়ে আছে। তাঁর অন্তরের প্রদীপ থেকে অনির্বান শিখা হাজারো অন্তরে বংশ পরম্পরায় জ্বলছে এবং জ্বলবে। অনন্তকাল ধরে এই প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকবে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা মরহুমকে মাগফেরাত ও জান্নাত দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক