রফতানি ও রেমিটেন্স আয়ের ওপর ভর করে করোনার প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা যেমনি শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করার আস্থা ফিরে পেয়েছেন, তেমনি সাধারণ মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে যুক্ত হচ্ছেন কাজে। একইসাথে করোনার পুরো সময়ে সচল থাকা কৃষিখাতে আরো প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব, দোকান ও বিপণি বিতানে বেচা-কেনা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আর্থিক খাতের বিভিন্ন সূচক অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসার সুস্পষ্ট আভাস দিচ্ছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশংসাও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন করোনায় প্রাণহানির ঘটনা যদি বড় আকারে আর না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এডিবির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের সেপ্টেম্বর আপডেটে এই পূর্বাভাস এসেছে। তবে এই পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে মহামারীকেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে এডিবি। অর্থাৎ বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য দেশগুলোতে মহামারির সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।
সংবাদে এডিবি’র বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এডিবি বলছে, উৎপাদনের গতি বাড়ায় এবং বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতা দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০২১ সালে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে এবং চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিকে জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই ধারা টেকসই করতে সামষ্টিক অর্থনীতির বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কর্মসূচির বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার পরামর্শ এসেছে প্রতিবেদনে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি এক বছর আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ২৯৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যেখানে মূল অবদান পোশাক খাতের। জুলাই ও আগস্ট মিলিয়ে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৭০ কোটি ডলারের।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোশাক খাত ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের কৃষি খাতও ভালো করছে। রেমিট্যান্স আসছে। এই সবই অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ। তাঁদের মতে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তবে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। আগামী কয়েক মাসে পশ্চিমা দেশগুলোতে মহামারি কী অবস্থা ধারণ করে তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে এই পুনরুদ্ধারের গতি। আর এটাই এখন অনিবার্য প্রশ্ন। আগামী দিনগুলোতে মহামারি কোন দিকে মোড় নেবে? পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের খুব ছোট একটি অংশই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সরকার দেশজুড়ে লকডাউন জারি করার পর পোশাক খাত প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকে। বন্ধ থাকা কারখানাগুলো আবার ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন করোনাভাইরাস অতিমারির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মত সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতির কালো মেঘ কেটে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাজারে নগদ অর্থের সরবরাহ সচল রেখে অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মত সাহসী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ভাল ছিল। তিনি বলেন, করোনায় যদি বড় আকারে প্রাণহানি না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। তিনি করোনায় সৃষ্ট বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সুবিধা বিশেষ করে চীন থেকে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার বিষয়ে সরকারকে আরো তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন। দেশের অর্থনীতির চাকা ভালোভাবে ঘোরার ওপর নির্ভর করবে জীবনযাত্রা সচল হওয়ার পূর্ণ আয়োজন।