নর্ডিক দেশগুলির কথা এর আগে এই পাতায় উল্লেখ করেছিলাম। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অতি উন্নত পাঁচটি দেশ নিয়ে ইউরোপের উত্তরে নর্ডিক দেশগুলি– সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আইসল্যান্ড– অবস্থিত। এবার সুইডেন সফরে যে স্থানটি দেখতে যাবো বলে ঠিক করেছিলাম সেটি হলো সুইডেনের, কেবল সুইডেনের বলি কেন, ইউরোপের প্রাচীন ও নানা কারণে খ্যাত ‘উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়’। বিশ্বের একশত সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থান করে নিয়েছে। স্টকহোমের যে স্থানে ভাগ্নি জামাই জুয়েলের বাসা সেখান থেকে গাড়ি পথে ৬০ কিলোমিটার দূরে এই বিশ্ববিদ্যালয়। জানা ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক ফ্যাকাল্টিতে রাখা আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রোঞ্জের তৈরি একটি আবক্ষ মূর্তি। কিন্তু কোথায়, কোন ফাকাল্টিতে তা সঠিক জানা ছিলনা। স্টকহোম পৌঁছার পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা, আমরা বলতে আমি, গিন্নি সুমনা, ভাগ্নি কণিকা, জুয়েল এবং তাদের দুই কন্যার ছোটজন, অহিন্দিতা রওনা দেই উপসালা শহরের উদ্দেশ্যে। ‘সুইডেনের ক্যামব্রিজ’ নামে পরিচিত উপসালা একটি প্রাণবন্ত ‘বিশ্ববিদ্যালয় শহর’। রাজধানী স্টকহোমের উত্তরে অবস্থিত এই শহরের বাসিন্দাদের প্রায় ২০% শিক্ষার্থী। বিভিন্ন দেশের ছেলে–মেয়েরা আসে এই শহরে, উচ্চ শিক্ষার জন্যে। এই শহরের রয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লেভার’। স্টকহোমে কাজ করেন এমন অনেকেই উপসালা থাকতে পছন্দ করেন বলে জানা যায়। রাজধানী স্টকহোম থেকে ট্রেনে এই শহরে যেতে সময় লাগে মাত্র ৩৫ মিনিট, যদিও বা গাড়ি পথে আর একটু বেশি। ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন বলতে হয়। রৌদ্রস্নাত দিন, যদিও বা ঠান্ডা বেশ, কনকনে না হলেও। জুয়েল খবর নিয়ে জানালে, আবক্ষ মূর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে রাখা আছে। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। লাইব্রেরির একপাশে গাড়ি পার্ক করে আমরা প্রবেশ করি বড় আকারের লাইব্রেরি ভবনে। রিসেপশনে বসা সুইডিশ মহিলাকে জুয়েল বলে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য। সুইডিশ ভাষায় ওদের কথোপকথন। অতএব নীরব দর্শকের মত পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। মহিলা বোধকরি এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনলেন। কিন্তু যখন পেছনের কাহিনী সংক্ষেপে বলা হলো তখন বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। নোবেল বিজয়ীর আবক্ষ মূর্তি দেখতে এতো দূর থেকে এসেছি জেনে মহিলা ধরে নিলেন আমরা সিরিয়াস দর্শনার্থী বা ট্যুরিস্ট। অনলাইনে সার্চ দিয়ে তিনি তথ্য পেয়ে বিষয়ের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পারলেন বলে মনে হলো। ম্যাপ দেখিয়ে আমাদের বললেন, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনের হিউম্যান ফ্যাকাল্টিতে যেতে হবে, সেখানে এটি আছে। মনে মনে বলি, ইউরেখা। ওই ভবন থেকে বেরিয়ে আমরা মহিলার নির্দেশিত পথ ধরে এগিয়ে যাই উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কাছেই ভবনটি। ছাত্র–ছাত্রীদের তেমন ভিড় নেই। মাঝেমধ্যে তাদের দেখা মেলে। কেউ কেউ সাইকেলের পিঠে এগিয়ে চলেছে। স্টকহোমে সাইকেল তেমন চোখে পড়েনি, তবে উপসালায় এসে বেশ দেখলাম। সাইকেলের দেশ হল্যান্ড থেকে এসেছি তাই এই দৃশ্য ভালো লাগে। যদিও বা হল্যান্ডের তুলনায় এদেশে সাইকেলের সংখ্যা খুব কম। এটি দেশের শারীরিক গঠনের কারণে বলে ধারণা। উঁচু–নিচু পথ, রাস্তা, তাতে সাইকেল চালানো কষ্টকর, স্টকহোমে তো বটেই। যাই হোক, হিউম্যান ফ্যাকাল্টির দরোজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে যে জিজ্ঞেস করবো তেমন কাউকে চোখে পড়লো না। পরে টের পেলাম আমরা ভুল দরোজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর একটি কাউন্টার পেলাম। সেখানে এক তরুণী। উনিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা তার আবক্ষ মূর্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ভেতরে গিয়ে খুব সম্ভবত তার এক পুরুষ কলীগকে ডেকে আনলেন। তাকে বললে তিনি আমাদের বিনয়ের সাথে তাকে অনুসরণ করতে বললেন। ওই ভবনের দীর্ঘ করিডোর, অনেকগুলি ক্লাসরুম পার হয়ে আমাদের এনে দাঁড় করালেন একটি ছোট্ট হলঘরে। সেখানে বাইরে থেকে আর একটি প্রবেশ মুখের দরোজার বা–পাশে একটি স্তম্ভের ওপর রাখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় দেই। শান্তিনিকেতনের শিল্পী কিংকর বেইজের হাতে গড়া তার গুরুর মূর্তি মর্যাদার সাথে রক্ষিত আছে ইউরোপের এক অতি উন্নত দেশে। স্তম্ভের বুকে লেখা আছে কটি শব্দ, তাতে আছে কবির পরিচিতি ও শিল্পীর নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারত সরকার ২০১৪ সালে এটি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে।
সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা এগিয়ে যাই সুইস রাজার পুরানো এক প্রাসাদের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পাহাড়ের উপর বেশ বড় এলাকা নিয়ে এই রাজপ্রাসাদ। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে এগিয়ে গেছে গাড়ি–রাস্তা। আমাদের গাড়ি উপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রাসাদের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের বড়সড় স্থান। বর্তমানে রাজা কিংবা রাজবাড়ির কেউ থাকেন না এই প্রাসাদে। সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তফ পঞ্চদশ (জন্ম ৩০ এপ্রিল ১৯৪৬)। তিনি জন্মগ্রহণ করেন তার পিতামহ রাজা গুস্তফ পঞ্চমের শাসনামলে। বর্তমান রাজা ছিলেন তার বাবা, প্রিন্স গুস্তফ এডল্ফের একমাত্র সন্তান। এক প্লেন দুর্ঘটনায় তার তার বাবা মারা যান। তখন তার বয়স মাত্র নয় মাস। তার বয়স যখন চার তখন তার দাদা গুস্তফ এডল্ফ ষষ্ট সিংহাসনে বসেন ১৯৫০ সালে এবং তিনি (বর্তমান রাজা) হন ক্রাউন প্রিন্স, অর্থাৎ দাদা মারা গেলে তিনিই হবেন এই সিংহাসনের অধিপতি। ১৯৭৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দাদা মারা গেলে গুস্তফ রাজা হন। কিন্তু রাজ্য শাসন করা তার কপালে বেশি দিন সইলো না। এক বছরের মাথায় (১৯৭৪) সরকার ক্ষমতায় এসে রাজতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়। বর্তমানে রাজা হলেন অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাথের মত, কিছু রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই। তবে দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা তাকে সরকার থেকে নিয়মিত ব্রিফ করা হয়। রাজার রয়েছে শখ। রাজার শখ রাজকীয় হবে এটিই স্বাভাবিক। দামি গাড়ির মালিক হওয়া তার অন্যতম শখ। যে সমস্ত গাড়ি তার আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কয়েকটি পরসে ৯১১, ভিনটেজ ভলভো পিভিই ৪৪৪, ফেরারি ৪৫৬ জিটি, এসি কোবরা ছাড়া আরো অনেক গাড়ি। চোখে পড়ে প্রাসাদের শেষ মাথায় হাতের ডানে একটি খোলা দরোজা। সেখানে পর্যটকদের কেউ কেউ ভেতরে প্রবেশ করছেন, কেউ কেউ বেরিয়ে আসছেন। কাছে গিয়ে টের পেলাম সেটি একটি ছোটখাট মিউজিয়াম। আহামরি কিছু নয়, সুইডেনের পুরানো দিনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ছবি ও পেইন্টিংয়ের মধ্যে দিয়ে। কীভাবে বড় বড় গাছ কেটে, পাহাড় কেটে বড় বড় রাস্তা, ভবন বানানো হয়েছে ছবি সম্বলিত তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। মিনি সাইজের মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, অহিন্দিতা অনেকক্ষণ ধরে আবদার করে আসছিল ম্যাকডোনাল্ডসসে যাওয়ার জন্যে। দুপুরও প্রায় গড়িয়েছে। অতএব, জুয়েলের গাড়ি ধীরে ধীরে নামতে থাকে পাহাড়ের ওপর ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজার এক পরিত্যক্ত প্রাসাদকে পিছু ফেলে। আগেই বলেছি এই রাজবাড়িতে রাজা বা রাজার কোন সদস্য থাকেন না। তার দখলে কয়টা প্রাসাদ আছে জানা নেই। জানার চেষ্টাও করিনি। আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নিয়ে কী লাভ। তবে এটি জানি যে তিনি থাকেন ভিন্ন এক রাজপ্রাসাদে। সেটি দেখার সুযোগ হয়েছিল নোবেল মিউজিয়াম যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন। রাজ দর্শন মিলবে এই আশায় অনেক কৌতূহলী দর্শক–পর্যটকদের মত আমরাও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, রাজপ্রাসাদের বাইরে। সেখানে সারিবদ্ধ সশস্ত্র পাইক–পেয়াদা। কিন্তু রাজা বের হননি। আমাদেরও ফেরার তাড়া ছিল। রাজার সময়ের মূল্য আছে, আমাদের যে একেবারে নেই তা কী করে হয়। তাই মিনিট পনের অপেক্ষা করে আমরা ফিরে আসি।
ম্যাকডোনাল্ডসে কফি, বার্গার খেয়ে আবারো আমাদের বেরিয়ে যাবার পালা। হাতে দিনের অনেকটা সময় তখনো। কিন্তু হলে কী হবে, এ দেশে দুপুর পৌনে চারটার দিকে সূর্য ডুবতে শুরু করে। রাত অনেক বড়। অন্ধকার, তার ওপর হাঁড় কাঁপানো শীত– এমন আবহাওয়ায় কি ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে? জুয়েল জানালো, কেবল এই আবহাওয়ার কারণে এখানকার মানুষেরা ‘ডিপ্রেশনে’ ভোগে। অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। বুড়ো থেকে শুরু করে অল্পবয়সীরাও। এই নিয়ে বিগত সংখ্যায় এই পাতাতে লিখেছিলাম। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে যখন বের হই তখনো আঁধার নামেনি। কিছুটা সময় হাতে আছে। জুয়েল জানালে ধারে কাছে একটি ‘গ্লাস হাউস’ আছে। সেখানে যাওয়া যায়। সেখানে গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য ততক্ষণে সেটি বন্ধ। আমাদের ফিরে চলার পালা। কিছুদূর যেতেই সামনে দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম। কম করে হলেও কয়েক কিলোমিটার তো হবেই। কিছুক্ষণ পর পর সাইরেন বাজিয়ে কয়েকটি পুলিশের গাড়ি ও এম্বুলেন্স সামনের দিকে এগিয়ে যায় দ্রুতগতিতে, আমাদের পিছু রেখে। অনুমান করি সামনে কোথায়ও কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সব গাড়ি সারিবদ্ধ ধীর লয়ে এগিয়ে চলে। নিয়ম ভাঙার চেষ্টা কারো নেই। হতো যদি আমার দেশে, তাহলে এই যানজট দিনের বাকি সময়টুকুও খুলতো না। নিয়ম ভাঙার অনিয়মটাই তো আমাদের দেশে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধঘন্টারও বেশি সময় ধীরগতিতে চলার পর দেখি রাস্তা পরিস্কার। কোন ভিড় নেই। আমাদের গাড়ির গতি দ্রুত হয়।
(১২–১২–২০২৪) চলবে
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট