চট্টগ্রাম বন্দরে ঢাকামুখী কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে গতি আনাসহ কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয় পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। কিন্তু নৌপথে পণ্য পরিবহনে ৯ বছরেও গতি আসেনি। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র দুই শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয় নৌপথে। সাশ্রয়ী নৌ রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও লাভ হচ্ছে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বলেছেন, নানা ভোগান্তির পাশাপাশি খরচও বেশি পড়ছে। তাই নৌপথের পরিবর্তে সড়কপথই তাদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, এই টার্মিনালে কন্টেনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে।
জানা যায়, অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে কন্টেনার পরিবহনের বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএর মালিকানাধীন ৫৫ একর জায়গায় এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ঢাকামুখী কন্টেনারের চাপ কমানো, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গাড়ির চাপ কমানো, রাস্তার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি, ঢাকা অঞ্চলের আমদানি-রপ্তানিকারকদের খরচ সাশ্রয়সহ বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে টার্মিনালটি গড়ে তোলা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই টার্মিনালে নিয়মিত কন্টেনার আনা-নেয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত ঢাকা অঞ্চলের যেসব কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে সেগুলো এখান থেকে ছোট আকৃতির জাহাজে করে পানগাঁও টার্মিনালে নেয়া হবে।
অপরদিকে ঢাকা অঞ্চলের রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো পানগাঁও থেকে ফিরতি জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। এখান থেকেই ফিডার ভ্যাসেলে ওই কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্টে পোর্টে চলে যাবে। এতে ঢাকা অঞ্চলের কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থায় মহাসড়ক এবং রেলওয়ের উপর যে চাপ পড়ে তা কমে যাবে। একই সাথে ব্যবসায়ীদের খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে। কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকলেও গত ৯ বছরে পানগাঁও টার্মিনালে গতি আসেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা ছোট আকৃতির কন্টেনার জাহাজ কিনে এই রুট জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
শুধু কন্টেনার নয়, খোলা পণ্য পরিবহনেও নৌপথের চেয়ে সড়কপথের উপর বেশি নির্ভর করেন আমদানিকারকেরা। খরচের দিক থেকে সড়ক ও রেলপথের চেয়ে সুবিধা বেশি হলেও নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের। চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব পণ্য আনা-নেয়া করা হয় তার মাত্র দুই শতাংশ পরিবাহিত হচ্ছে নৌপথে। বাকি ৯৮ ভাগ পণ্যের সিংহভাগ পরিবাহিত হয় সড়কপথে। সামান্য অংশ যায় রেলপথে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে নৌপথে ৪ লাখ ৫ হাজার ২৮৮ টন পণ্য পরিবহন করা হয়। ওই বছর রেলপথে পরিবহন করা হয়েছিল মাত্র ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৬২ টন। সড়কপথে ২ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার ১০৬ টন পরিবহন করা হয়। ২০১৮ সালে নৌপথে ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৬ টন, রেলপথে ৯ লাখ ১৪ হাজার ৯০৩ টন এবং সড়কপথে পরিবহন করা হয়েছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ ৪৭ হাজার ৭২৩ টন পণ্য। ২০১৯ সালে নৌপথে ৬ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৯ টন, রেলপথে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৩০৫ টন এবং সড়কপথে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫ হাজার ৬০২ টন পণ্য পরিবহন করা হয়।
২০২০ সালে নৌপথে ৮ লাখ ৭১ হাজার ৭৬৯ টন, রেলপথে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪২৭ টন এবং সড়কপথে ২ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার ৭২৫ টন পণ্য পরিবহন করা হয়। ২০২১ সালে নৌপথে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৯৩৮ টন, রেলপথে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ২৬০ টন এবং সড়কপথে ২ কোটি ৬১ লাখ ১৯ হাজার ৯৪৪ টন পণ্য পরিবহন করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পানগাঁও টার্মিনালে কন্টেনার বুকিংয়ের ক্ষেত্রে মেইন লাইন অপারেটররা (এমএলও) অত্যধিক ভাড়া আদায় করার ফলে এই টার্নিনাল ব্যবহার করা কঠিন হয়ে উঠেছে। পণ্য পরিবহনে দীর্ঘ সময় এবং অতিরিক্ত খরচের কারণেই মূলত নৌরুটে পণ্য পরিবহনে প্রত্যাশিত গতি আসছে না।
চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ী আজাদীকে বলেন, আসলে পণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি জটিল। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে নামানো; সেখান থেকে ঢাকা বা গাজীপুরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। এর চেয়ে একবারেই ট্রাক বা ট্রলিতে তুলে দেয়া হলে পণ্য গন্তব্যে চলে যায়। কিছু বাড়তি খরচ হলেও ভোগান্তি কমে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি নৌপথে পণ্য পরিবহন না করে সড়কপথে করেন।
অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনালে কন্টেনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে নৌপথে পণ্য পরিবহন। গত বছর এই টার্মিনালে ২৭ হাজার টিইইউএসের মতো কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। এই বছর এই সংখ্যা অন্তত ১০ শতাংশ বাড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম পানগাঁও টার্মিনালের মধ্যে দশটিরও বেশি ছোট কন্টেনার জাহাজ চলাচল করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই টার্মিনাল ব্যবহারের জন্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের আহ্বান জানিয়ে আসছে।