৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত

মোখার অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে আজ সন্ধ্যায় বাড়ছে বাতাসের গতি, জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ১৬০৬ আশ্রয়কেন্দ্র

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৩ মে, ২০২৩ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

শক্তি বৃদ্ধি করে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে ‘মোখা’। আগামীকাল রোববার আঘাত হানতে পারে পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়টি। এদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ‘মোখা’ কক্সবাজারউত্তর মায়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অবশ্য আজ শনিবার সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজার ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ‘মোখা’র অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে বলেও জানায় সংস্থাটি। এছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১০ লাখ ৭ হাজার ১০০ মানুষকে আশ্রয় দিতে ১ হাজার ৬০৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া আরো নানা প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। গতকাল শুক্রবার উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে।

জেলেপল্লীতে আতংক ও সতর্কতা : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’কে ঘিরে নগরের পতেঙ্গাস্থ জেলেপল্লীর বাসিন্দাদের মাঝে আতংক দেখা গেছে। তারা জানিয়েছেন, গত বছর অক্টোবর মাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। ওইসময় পতেঙ্গা জেলেপল্লীর প্রায় ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণে এবার তারা নিচ্ছেন বাড়তি সতর্কতা। গতকাল সকাল থেকেই জালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিরাপদে সরিয়ে নিতে দেখা গেছে জেলেদের।

বাড়ছে বাতাসের গতি, শঙ্কা জললোচ্ছ্বাসের : ‘মোখা’ যতই অগ্রসর হচ্ছে কতই বাড়ছে বাতাসের গতি। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় অতি প্রবল এ ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগে দুপুর ১২টায় বাতাসের এ গতিবেগ ছিল ১৩০ কিলোমিটার। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। এছাড়া উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি রয়েছে। কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ২০ ফুট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী উপকূলীয় এলাকায় ১০ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আবহাওয়া অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুদ্ধ রয়েছে। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে রাতে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা ৮ মে রাতে সুস্পষ্ট লঘুচাপে এবং ৯ মে ‘নিম্নচাপে পরিণত হয়। ১০ সকালে আরো শক্তিশালী হয়ে তা গভীর নিম্নচাপে এবং ১১ মে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।

উল্লেখ্য, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের দেওয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হয়। মোখা নামটি ইয়েমেনের দেয়া।

চট্টগ্রাম থেকে কত দূরে : গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল ‘মোখা’। এর আগে দুপুর ১২ টায় চট্টগ্রাম থেকে ১ হাজার ৫ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার থেকে ৯৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল ঘূর্ণিঝড়টি।

ভারতীয় আবহাওয়া অফিস যা বলল : ভারতীয় আবহাওয়া অফিস জানায়, রবিবার দুপুরে মোখা স্থলভাগে আঘাত করতে পারে। এসময় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। এ দমকা হাওয়ার বেগ পৌঁছতে পারে ১৭৫ কিলোমিটারেও। ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রকে উত্তাল রাখবে। সমুদ্রের উপর বাতাসের বেগ কোথাও কোথাও প্রতি ঘণ্টায় ১৪৫ থেকে ১৫০ কিলোমিটার হতে পারে। এর ফলে উপকূল এলাকায় উঁচু ঢেউ দেখা দিতে পারে।

যে কারণে মোখা নিয়ে ভয় : যে কোনো ঘূর্ণিঝড় যত বেশি সময় ধরে সাগরের অবস্থান করে তার তত শক্তি এবং ধ্বংসক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এদিকে রোববার দুপুরে আঘাত করলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর থেকে ৭২ ঘণ্টা সাগরে অবস্থান করবে ‘মোখা’। বেশি সময় সাগরে বেশিক্ষণ থাকার ফলে এটি শক্তি সঞ্চয় করে। পরবর্তীতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আঘাত করলে ধ্বংসক্ষমতাও বেশি হয়। তাই এ ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ভয় বাড়ছে।

অবশ্য ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, আজ শনিবার ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কিছুটা ক্ষয় হতে পারে। তা না হলে আরো বিধ্বংসী হতে পারে ‘মোখা’। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আজ শনিবার মোখার অগ্রভাগ আঘাত করতে পারে। সেক্ষেত্রে মোখার শক্তি কিছুটা ক্ষয় হওয়ার যে পূর্বাভাস ভারতীয় আবহাওয়া অফিস দিয়েছে তা সত্যি হতে পারে।

প্রস্তুত ১ হাজার ৬০৬ আশ্রয়কেন্দ্র : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আঘাত হানলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রাম কক্সবাজারে এক হাজার ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতক করা হয়েছে। এতে ১০ লাখ সাত হাজার ১০০ জনকে আশ্রয় দেওয়া যাবে। এর মধ্যে চট্টগ্রমের ৫৩০টি স্থায়ী এবং ৫০০টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ ১ হাজার ১১০ জন। নগরে রয়েছে ৯৪টি আশ্রয়কেন্দ্র।

এছাড়া কক্সবাজারের ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়। সেখানে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৯৯ জনকে আশ্রয় দেয়া যাবে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামে নগদ ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এছাড়া ৬০৮ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে তিন মেট্রিক টন টোস্ট বিস্কুট, তিন মেট্রিক টন ড্রাই কেক ও ৩০ হাজার প্যাকেট খাবার স্যালাইন মজুত রাখা হয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্রস্তুত করা হয়েছে ৬০ হাজারটি। চট্টগ্রামে সিপিপির ৮ হাজার ৮৮০ জন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আট হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এদিকে কক্সবাজারের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নগদ ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫৯০ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে তিন মেট্রিক টন টোস্ট বিস্কুট, তিন টন ড্রাই কেক, ২০ হাজার খাবার স্যালাইন ও ৪০ হাজারটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় রাতের আঁধারে বসতবাড়িতে তাণ্ডব, গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সীমানাপ্রাচীর